পাঠাগার হোক গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়
জ্ঞান নির্ভর ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে ‘‘পাঠাগার হোক গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়’’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশের সব বেসরকারি পাঠাগার নিয়ে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের অর্জুনা গ্রামে ৩ দিনব্যাপী পাঠাগার সম্মেলন গত ২২-২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ এ আয়োজিত হয়।
আমাদের মানসিক বিকাশে পাঠাগার আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারাদেশের ৪৫০ প্রতিনিধির অংশগ্রহণে টাঙ্গাইল জেলার ভুঞাপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম- অজুনায় সম্মিলিত পাঠাগার সম্মেলন এর উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলন প্রতিটি বইপ্রিয় পাঠক, সংগঠক ও সংগঠন ও পাঠাগারের পথপ্রদর্শক ও অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
পাঠাগার সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার দেশ বরণ্য কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক ও গবেষকদের পদচারণায় মুখরিত হয় সম্মেলনস্থল। সম্মেলনে দেশের ১৭০টি বেসরকারি পাঠাগারের প্রতিনিধি সমবেত হন। পাশাপাশি সম্মেলনে পাঠাগারসহ বিভিন্ন প্রদর্শনী স্টল অংশগ্রহণ করে।
৩ দিনব্যাপী এ পাঠাগার সম্মেলনে আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে প্রতি সন্ধ্যায় আয়োজিত হয় গ্রামীণ লোকসংগীত, বাউল গান, পালা গান, জারি গান পরিবেশিত হয়। সম্মেলনে পাঠাগারের সংকট, সম্ভাবনা, প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে বেসরকারি পাঠাগারের টিকে থাকার কৌশল, পাঠক বৃদ্ধির উপায়, কার্যকর পাঠাগার আন্দেলনে সরকারের করণীয়, পাঠাগার সম্পর্কিত দাবি-দাওয়া, সমাজে পাঠাগারের ভূমিকা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচিত হয়। উপস্থাপিত হয় গ্রাম পাঠাগারের নানাবিধ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।
আয়োজন অনেক সুনিয়ন্ত্রিত, চমৎকার ও প্রাণবন্ত ছিল। সীমিত সামর্থে্য অতিথি আপ্যায়ন আন্তরিক ছিল। বাংলাদেশে এই প্রথম দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১৭০টি পাঠাগার অংশগ্রহণ করে। এটি পাঠাগার আন্দোলনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।
প্রত্যন্ত গ্রাম ব্যতীত আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় নগর-শহরের স্কুলগুলোর অবস্থান অনেকাংশে আকাশ ছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্টে। কাক ডাকা ভোরে বিশাল তালিকার বই এর বোঝার ভার কাঁধে বহন করে ইটকাঠের স্কুলে আবদ্ধ হয়ে চলে শিশুদের শিক্ষাকার্য। সেখানে বাগান নেই, পার্ক নেই, পুকুর নেই, মাঠ নেই, পাঠাগার নেই, বাবা মার সঙ্গ দেয়ার সময় নেই, খেলার সাথী নেই, পড়ালেখার অতি প্রতিযোগিতায় ভালো কোন অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করারও কেউ নেই! আবদ্ধ রঙিন চার দেয়ালের মধ্যে ঘুরছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভিড়ে শিশুদের নরম ইচ্ছে গুলো।
শিশুদের কিশোরদের বিকাশে নতুন ভাবনায় আমাদের ভাবতে হবে। সেই সাথে উদ্যোগ নিতে হবে- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারে দেশীও সংস্কৃতির চর্চা। গড়ে তুলতে হবে সময়োপযোগী আধুনিক পাঠাগার। আমাদের দেশে মেধাবী, প্রযুক্তি দক্ষ ও সৃজনশীল মানুষের অভাব নেই কিন্তু অভাব আছে সঠিক উদ্যোগের।
কোভিড -১৯ এর কারণে মহামারির সময় থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সংযোজিত হয়েছে - ‘অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম’। এটি যেমন শিক্ষাকার্যক্রম অথবা যোগাযোগের মাধ্যম তেমনি একটি বিনোদনেরও মাধ্যম। মোবাইল ফোনে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিতে বিভিন্ন বয়সী প্রজন্ম, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, বাড়ির কাজ করার সময় এবং এমনকি স্কুলের পাঠের সময় নিয়মিত তাদের ফোন চেক করে থাকে। বলা যেতে পারে, ফোন ছাড়া থাকা ব্যবহারকারীদের চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রজন্ম সাম্প্রতিক সময়ে এমন একটি রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি পরিবেশে বেড়ে উঠছে যা মানব ইতিহাসে আগে কখনো ছিল না। মোবাইল ফোন এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে নির্গত বিকিরণ নানাভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমাদের শরীরে সেল ফোন বিকিরণের প্রভাব সম্পর্কে অনেক গবেষণা চলছে।
সা¤প্রতিক বছরগুলোতে গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোনের অত্যাধিক ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার দৃষ্টি সমস্যার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সমীক্ষায় সেল ফোন ভিশন সিন্ড্রোম দেখা গেছে। মোবাইল কল শিশুদের মস্তিষ্কের হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী অনেকটা সময়ে তাদের মস্তিষ্কে থেকে যায়।
ফলে ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়। দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে এমনকি নিয়মিত ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়। স্ক্রিনের রেডিয়েশন প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; শিশুদের জন্য তা আরও বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর- যা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে।
জ্ঞান-নির্ভর ও ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্খা মানুষের বহুদিনের। প্রযুক্তি নির্ভর জনগোষ্ঠী অথবা বইবিমুখ বর্তমান প্রজন্মকে বইপড়া অভ্যাসে অভ্যস্ত করতে বিভিন্ন আয়োজন প্রয়োজন। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া জাতীয় চেতনার জাগরণ হয় না। পৃথিবীর বহুদেশ পাঠকের চাহিদা পূরণের জন্য গড়ে তুলেছে অগণিত পাঠাগার। শিক্ষার আলো বঞ্চিত কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি।
পাঠাগার শিক্ষার বাতিঘর। পাঠাগার ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তার নাগরিককে পরিপূর্ণ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। অনেকেরই বই পড়ার ইচছা থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে বই কিনতে পারে না। মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই পাঠাগারের সৃষ্টি। শতাব্দী থেকে শতাব্দী বছর ধরে মানুষের জ্ঞান জমা হয়ে থাকে পাঠাগারের বইয়ের পাতায়। সে বিবেচনায় পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি সমাজে অনিবার্য।
পাঠাগারে বই ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রীর একটি সংগ্রহশালা যেখানে পাঠকের প্রবেশাধিকার থাকে এবং পাঠক সেখানে গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধ্যান করতে পারে। পাঠাগারে প্রথাগত বইপড়ার সুযোগ ছাড়াও সময়োপযোগী প্রযুক্তি সহায়ক হিসেবে বিভিন্ন উদ্ভাবক সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। পাঠকদের মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়, যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্যে নেটওয়ার্কিং থাকতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের চিন্তার ঐক্যসূত্রের মাধ্যম হতে পারে পাঠাগার।
লেখক: গবেষক।
এইচআর/জিকেএস