সলঙ্গা দিবসের ১০১ বছর
চাই দেশপ্রেমের নবজাগরণ
সোমবার সলঙ্গায় হাট বসতো। জানুয়ারির ২৭ তারিখ হাটে গিয়ে বিলেতি পণ্য বর্জনের ডাক দেন আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। হাটে তর্কবাগীশের কর্মীরা লোকজনকে বিলেতি পণ্য না কেনার আহ্বান জানান এবং সচেতনতা কার্যক্রম চালান। খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জের তদানীন্তন মহকুমা প্রশাসকের নেতৃত্বে পুলিশ উপস্থিত হয়ে আন্দোলন বন্ধ করতে নির্বিকারে গুলি চালায়। সেই থেকে ২৭ জানুয়ারি সলঙ্গা দিবস।
১৯২২ সালের এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহ- সলঙ্গা গণহত্যা। সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা হাটে সেদিন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর তাই তো ব্রিটিশবিরোধী মুক্তিকামী মানুষের জীবন বিলানোর তেজস্বী সংগ্রামের আখ্যান সলঙ্গা বিদ্রোহ এবং মাওলানা তর্কবাগীশ এক ও অবিচ্ছিন্ন একটি বিষয়।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বিচরণ ছিল মাওলানা তর্কবাগীশের। পরে তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, এমনকি আশির দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অবধি দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। উপমহাদেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোর তাগিদে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এ দেশের জনতা দল-মত নির্বিশেষে এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি। তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার) ব্যবসায়িক জনপদ সলঙ্গায় বড় হাটবার ছিল সেদিন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তরুণ জননেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে নেমেছিলেন। উদ্দেশ্য ব্রিটিশদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা। সলঙ্গার হাটে বিলেতি পণ্য বেচাকেনা চলবে না। সলঙ্গার হাট হবে কেবল স্বদেশি পণ্যের হাট- এই ছিল স্লোগান।
এই স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের দমন করতে ৪০ জন সশস্ত্র পুলিশের একটি দল নিয়ে ছুটে আসে সে সময়ের পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক। সলঙ্গার গোহাটিতে বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের কংগ্রেস কার্যালয় ঘেরাও করে তারা। সেখান থেকে নেতৃত্বদানকারী মাওলানা তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। তাঁকে মুক্ত করতে জনতার বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়।
ইতিহাস বলে, ৪০ জন সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশের মধ্যে একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ পুলিশ ছাড়া ৩৯ জন পুলিশই সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাজা রক্ত আর নিথর লাশের স্তূপ জমে যায় সেখানে। সেই গণহত্যায় সাড়ে চার হাজার সংগ্রামী জনতা হতাহত হয়েছিল। ব্রিটিশদের হাতে তাঁদের গণকবর রচিত হয়েছিল। ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে যাওয়ার পেছনে সলঙ্গার আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকার দাবি রাখে। এই আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘রক্তসিঁড়ি’ হিসেবে পরিচিত।
মাওলানা খন্দকার আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার তারুটিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন। ছেলেবেলা থেকে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সারা জীবন তিনি শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। মানুষের অধিকার আদায়ের, অকল্যাণের বিরুদ্ধে কল্যাণের রাজনীতি করে গেছেন। ১৩ বছর বয়সে তিনি দরিদ্র দুধ বিক্রেতাদের সংগঠিত করে দুধের ন্যায্যমূল্য প্রদানে মহাজনদের বাধ্য করেছিলেন।
তিনি ১৯৩৩ সালে রাজশাহী চাঁটকৈড়ে নিখিল বঙ্গ রায়ত খাতক সম্মেলন আহ্বান করে ঋণ সালিশি বোর্ড আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখেন। ১৯৩৭ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নাটোরে কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন। ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বাংলা, আসাম ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি যখন ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সেই সংগঠনের সভাপতি। পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে মহান ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সে বছর ২২ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন।
১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি নির্মাণে যেসব মনীষী কালজয়ী অবদান রেখেছেন, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ছিলেন অন্যতম।
সলঙ্গা আন্দোলন-সলঙ্গা গণহত্যা এবং এই আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা মাওলানা তর্কবাগীশের রাজনৈতিক ইতিহাস এত অল্প পরিসরে জানানো সম্ভব নয়। তবে এই ইতিহাসে সে সময়ের রাজনীতির একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে ভারতবর্ষে বীরের জাতি বাঙালির নির্ভীক রাজনৈতিক প্রচারণার কথা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- এরা ছিলেন সে সময়ে রাজনীতির প্রতিকৃতি।
তাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য, দেশের জন্য রাজনীতি করতেন বলেই হয়তো মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সলঙ্গা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘রক্তসিঁড়ি’ রচনা করতে পেরেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিতে পেরেছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। তাঁরা স্বার্থের রাজনীতি করেননি, জীবনের মায়া করেননি, নিজের জন্য ভাবেননি। ভেবেছেন দেশের জন্য। দেশের মানুষের রাজনীতি করেছেন তারা।
জানুয়ারির ২৭ তারিখ ‘সলঙ্গা দিবস’ উদযাপিত হবে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল পূর্ব পুরুষদের সংগ্রামের কথা বলা হবে। বলা হবে তাঁদের সাফল্যের কথা। সলঙ্গা আন্দোলনের বীর নেতা মাওলানা তর্কবাগীশের রাজনীতির বীরত্বগাথা ইতিহাসের সিজার লিস্ট করা হবে। স্বাভাবিকভাবেই সে সময়ের ইতিহাসের অংশ হিসেবে আমাদের পূর্ব পুরুষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা আসবে। আসতেই হবে। কারণ, তখনকার রাজনীতির লক্ষ্য ছিল একটিই। তা হলো মানুষের অধিকার ও কল্যাণ। এই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে গিয়ে জীবন বাজি রেখে রাজনীতি করেছেন তাঁরা। লক্ষ্য অর্জনে তাঁদের সাফল্য ছিল আকাশচুম্বী। তাঁরা আমাদের আদর্শের নেতা।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস