সৃষ্টিকর্তা যা অপছন্দ করেন
বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই শান্তির প্রত্যাশা রাখে আর নিরাপত্তাও চায়, কিন্তু বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের অধিকাংশই এই শান্তি লাভ করতে চায় না, তারা সেসব পথ অবলম্বন করতে সম্মত নয় যেপথে চললে শান্তি অর্জন সম্ভব। কেননা এই পথ যতটা সহজ ততটাই কঠিন। এই নীতি ও সমাধানের কথা বিশ্বস্রষ্টা পবিত্র কোরআনেও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘যারা ঈমান আনে এবং যাদের হৃদয় আল্লাহকে স্মরণ করে প্রশান্তি লাভ করে। শোন আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে’ (সুরা আর রাদ, আয়াত: ২৮)। তাই শান্তি ও নিরাপত্তা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর জেনে রাখো যে, তোমাদের মাঝে আল্লাহর রাসুল বিদ্যমান যদি সে তোমাদের অধিকাংশ কথা মেনে নেয় তবে তোমরা অবশ্যই দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হবে কিন্তু আল্লাহই তোমাদের জন্য ঈমানকে প্রিয় বানিয়ে দিয়েছেন। আর তা তোমাদের হৃদয়ে সুসজ্জিত করে দিয়েছেন আর তোমাদের জন্য কুফর ও মন্দকর্ম এবং অবাধ্যতার প্রতি তীব্র ঘৃণাও সৃষ্টি করে দিয়েছেন, এরাই ওইসব লোক যারা সুপথ প্রাপ্ত’ (সুরা আল হুজুরাত, আয়াত:৭)।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এটাই ইচ্ছা করেন যে, তার বান্দারা যেন সকল প্রকার অন্যায় আচরণ থেকে মুক্ত থাকে, কারো সাথে জুলুম না করে এবং তার দ্বারা যেন কোনো ধরনের মন্দ কর্ম সংঘটিত না হয়। নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে আমার কথা ও কাজ দ্বারা সৃষ্টির কেউ কোনো ধরনের কষ্ট না পায়। আর আমি যদি নিজেকে একজন আল্লাহ প্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে।
একটি হাদিস রয়েছে, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনকে গালিগালাজ করা বিদ্রোহাত্মক কর্ম আর তার সাথে লড়াই করা কুফর’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ১ম খণ্ড, ৪৩৯ পৃষ্ঠা, বৈরুতে মুদ্রিত)।
অপর একটি হাদিসে হজরত আব্দুর রহমান বিন শিবল বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা দুষ্ট প্রকৃতির হয়। বর্ণনাকারী বলেন, নিবেদন করা হলো, ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! আল্লাহতায়ালা ব্যবসা বাণিজ্য কি বৈধ করেননি? রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেন নয়? কিন্তু তারা যখন বেচাকেনা করে তখন মিথ্যা বলে আর কসম খেয়ে খেয়ে মূল্য বাড়ায়’। বর্ণনাকারী বলেন রাসুল (সা.) আরও বলেন,‘পাপাচারীরা নরকবাসী’। নিবেদন করা হলো ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! পাপাচারী কারা?’ এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘নারীরাও পাপাচারী হয়ে যায়।’ একজন ব্যক্তি নিবেদন করলো ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! ওরা কি আমাদের মাতা, ভগ্নি আর সহধর্মিণী নয়?’ মহানবি (সা.) উত্তরে বললেন ‘ কেন নয়! তবে তাদের কিছু দেয়া হলে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না আর তাদের ওপর যখন কোনো পরীক্ষা আপতিত হয় তখন তারা ধৈর্যও ধারন করে না’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ২য় খণ্ড, ৪২৮ পৃষ্ঠা, বৈরুতে মুদ্রিত)।
এখানে সেই সব ব্যবসায়ীদের ভেবে দেখা দরকার যারা মানুষদেরকে ঠকায়, মাপে কম দেয়, খারাপ জিনিষ দেয়। ব্যবসা বাণিজ্য খুবই পরিস্কার-পরিচ্ছন হওয়া উচিৎ, সৎ থাকা চাই।
আরেকটি বিষয়ের দিকে আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আমরা যেন ঐক্যবদ্ধ থাকি। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১০৩)
মহানবি (সা.) বলেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার মুসলমান ভাইয়ের ওপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না, তার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে না এবং তাকে অবজ্ঞা করবে না।’ (সহিহ বুখারি)
আমাদের মধ্যে কিছু লোকের অভ্যাস এমনও আছে যারা বিভিন্নভাবে লোকদের প্রতি জুলুম-অবিচার করে থাকি, আর কোনো ক্ষমতার অধিকারী হলে তো কথাই নাই। যারা বিভিন্নভাবে লোকদের প্রতি জুলুম করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা সতর্ক করেছেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘কিন্তু তাদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দল মতভেদ করে। অতএব ঐ লোকদের জন্য, যারা জুলুম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে এক কষ্টদায়ক দিনের আযাবের দূর্ভোগ’ (সুরা আয যুখরুফ, আয়াত: ৬৫)।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত জাবের (রা.) বর্ণনা করেছেন, হজরত মহানবি (সা.) বলেন, ‘জুলুম নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকো, কেননা কিয়ামত দিবসে তোমার কৃত জুলুম অন্ধকাররূপে ধেয়ে তোমার সামনে এগিয়ে আসবে। লোভ-লালসা, কৃপণতা ও বিদ্বেষপরায়নতা থেকে দূরে থাকো, কেননা লোভ-লালসা, কৃপণতা ও বিদ্বেষপরায়নতা আত্মমর্যাদাকে আক্রান্ত করে হত্যা করায় উস্কিয়ে দেয় আর সম্মানজনক বস্তুর মানহানী ঘটায়’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ৩য় খণ্ড, ৩২৩ পৃষ্ঠা)।
আমরা যদি কারো অধিকার হরণ করি তাও কিন্তু জুলুমের পর্যায়ে পেঁৗছে। এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ বর্ণনা করেন, আমি মহানবি (সা.)এর কাছে নিবেদন করি, ‘হে রাসুলুল্লাহ (সা.)! কোন্ জুলুমটি সবচেয়ে বড়?’ উত্তরে মহানবি (সা.) বললেন, ‘সব থেকে বড় অন্যায় এটা যে, কোনো ব্যক্তি নিজের ভাইয়ের প্রাপ্য অংশ থেকে একহাত পরিমান জমি জবর দখল করে। এমনকি ঐ জমির এক টুকরা পাথরও যদি সে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিয়ে থাকে, তবে পাথরের তলার ঐ জমিটুকু পরিপূর্ণ আকারের এক কাঁটায় পরিণত করে কিয়ামত দিবসে তার গলায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে। আর জমির তলদেশে কি লুকানো আছে তা ঐ পবিত্র সত্তা ব্যতিরেকে কেউই জানেনা, যিনি তা সৃষ্টি করেছেন’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯৬, বৈরুতে মুদ্রিত)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের তিনটি কাজ পছন্দ করেন এবং তিনটি কাজ অপছন্দ করেন। যে তিন কাজ তিনি পছন্দ করেন তা হলো, ক. তাঁর ইবাদত করা, খ. তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক না করা, গ. আল্লাহর রজ্জুকে দলবদ্ধ হয়ে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা-পরস্পর বিছিন্ন না হওয়া। আর যে তিন কাজ তিনি অপছন্দ করেন তা হলো-ক. অনর্থক কথা বলা, খ. মানুষের কাছে বেশি বেশি চাওয়া অথবা প্রশ্ন করা, গ. সম্পদ ধ্বংস করা।’(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৭১৫)
সমাজ থেকে সব ধরণের অশান্তি, জুলুম ও বিশৃঙ্খলামুক্ত করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে বলেই ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষ যদি শান্তি পেতে চায়, তাহলে তার নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন না করে আল্লাহর দেয়া বিধান মেনে চলতে হবে। তাই আল্লাহ তার সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ প্রেরিত বিধানের নাম রেখেছেন ইসলাম। মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম সেই অনন্ত শান্তির বাণীই প্রচার করছে। তাই তো শাশ্বত ধর্ম ইসলামের অনিন্দ্যসুন্দর আদর্শে মানুষ যুগ যুগ ধরে ইসলাম গ্রহণ করে আসছে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকল সব ধরনের অন্যায়, জুলুম ও মন্দ কর্ম থেকে বেঁচে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস