ডিজিটাল থেকে স্মার্ট
বাংলাদেশ বিশ্বকে অবাক করে দিবে
পাবনার ঈশ্বরদীতে এক বৃদ্ধা মা সুইডেনে থাকা তার মেয়ে এবং জার্মানিতে থাকা ছেলের সঙ্গে প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলেন। কথা বলেন, নাতি নাতনিদের সাথেও। বৃদ্ধাকে আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ছেলে মেয়ে দুজনেই বিদেশে থাকে আপনার খারাপ লাগেনা? তিনি হেসে বললেন, আমিতো সারাদিনই প্রায় ওদের সাথেই থাকি। দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, খুব ভালো লাগে। বললেন, এখনতো সারাদেশই ডিজিটাল হয়ে গেছে। তাঁর মুখে ডিজিটাল শব্দটা শুনে আমি সত্যি চমকে গিয়েছিলাম। সত্যিইতো সব ডিজিটাল সিস্টেমে চলে এসেছে।
আমরা সবাই জানি এই ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্মাতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও সব সময় বলে থাকেন, তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় তাঁকে একাজে সবরকম সহযোগিতা করেছেন। এই সিস্টেমের সাথে দেশের প্রতিটি মানুষ যখন জড়িয়ে পড়েছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, এবার তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন।
আমাদের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নানা মুনির নানা মত থাকলেও বিদেশিদের মুখে প্রশংসার শেষ নেই। বিশ্বের খ্যাতনামা পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস (১০ মার্চ, ২০২১) শিরোনাম লিখেছে ‘বাইডেনের পরিকল্পনা দারিদ্র্যের জন্য কি কাজে লাগতে পারে? বাংলাদেশের দিকে তাকাও।’ ৫০ বছর আগে গণহত্যা, অপরিচ্ছন্নতা ও ক্ষুধায় মৃত্যুর মধ্যে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশকে মনে হয়েছিল আশাহীন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বেড়েছে। করোনার আগের চার বছরের গড় প্রবৃদ্ধি চীনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। এর পেছনে অন্যতম রহস্য হলো মেয়েদের শিক্ষা ও কর্মে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশে এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ সবচেয়ে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর পেছনে বিনিয়োগ করেছে। এটা কোনো সহানুভূতি নয় বরং কোনো জাতিকে এগিয়ে নিতে এটি সাহায্য করছে, যা অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
আবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক পত্রিকা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (২৮ জুলাই ২০২২) লিখেছে, উন্নয়ন বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে অন্যরা কি শিক্ষা নিতে পারে? পত্রিকাটি বলছে, ‘দেশের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির কিছুটা সমস্যা থাকলেও এর দ্রুত অগ্রগতি থেকে আফ্রিকার দেশগুলো শিক্ষা নিতে পারে। বাংলাদেশ দেখিয়ে দেয় প্রকৃতপক্ষে কী করা সম্ভব এবং যারা অতীতের কিছু পারফরম্যান্সকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকনির্দেশক মনে করে হতাশা ব্যক্ত করে তাদের জন্য এটি বড় ধরনের তিরস্কার। বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধ থেকে জন্মলাভের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার মুখোমুখি হয়। সে সম্ভাবনাহীন সূচনা থেকে এ সাফল্যের সংস্করণ।’
আমেরিকার নিউইয়র্কভিত্তিক ম্যাগাজিন নিউজ-উইক বাংলাদেশকে নিয়ে কয়েকটি আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো, ‘অদম্য বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের অগ্রগতি অসাধারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রক্ষেপণ থেকে দেখা যাচ্ছে এটা সবে শুরু। সাম্প্রতিক দশকে বাংলাদেশ যে অভাবনীয় অগ্রগতি লাভ করেছে তাতে অনেকে যারা এখনো অতীতের গণ্ডিতে আবদ্ধ তাদের বাস্তবতা মেনে পুনরায় চিন্তা করতে ম্যাগাজিনটি বলছে। অন্য আরো একটি প্রতিবেদনে ম্যাগাজিনটি বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম গতিশীল ও সম্ভাবনাময়ী দেশ।
২০০৯ থেকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুত রূপান্তর ঘটেছে এবং আগামী অর্ধশতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের শুধু আঞ্চলিক পাওয়ারহাউজ নয় বরং বৈশ্বিক পাওয়ারহাউজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে যাচ্ছে।
জাপানভিত্তিক পৃথিবীর বৃহত্তম আর্থিক সংবাদ মাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার (২৩ নভেম্বর, ২০২০) শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ সঠিক কারণে তার সমালোচনাকারীদের হতবাক করে দিয়েছে।’ বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে সঠিকভাবে পূর্ব এশিয়ার মডেল হওয়ার পথে হাঁটছে। মানব পুঁজিতে বাংলাদেশের বড় বিনিয়োগ ঢাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে বিষন্ন পূর্বাভাসের সব ধরনের উপকরণই পর্যাপ্ত ছিল ঘনবসতিপূর্ণ শহর, অপ্রতুল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, কভিড-১৯-এর মতো দুর্যোগের আগমন, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে কভিড-১৯-এর সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ বোধহয় সবচেয়ে বিস্ময়কর।
নিক্কেই এশিয়া (৮ জুন, ২০২১) এর আরো একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাফল্য কোনো পূর্বনির্ধারিত ছিল না। ওয়াশিংটনভিত্তিক ডিপ্লোমেট ম্যাগাজিন (১৫ মার্চ, ২০২১) লিখেছে, বাংলাদেশ ৫০ বছরে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
ম্যাগাজিনটি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের উদাহরণ টেনে বলছে একসময় ক্ষুধায় জর্জরিত দেশটি এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পেছনে শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে।
ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা টাইমস্ অব ইন্ডিয়া (৩ এপ্রিল, ২০২২) লিখেছে, বাংলাদেশ কেন ভারতকে অনেক পেছনে ফেলেছে? ১৪ বছর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের মাত্র অর্ধেক ছিল। অথচ গত বছর ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকটি ছিল বাংলাদেশের জন্য সোনালি দশক। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য তা শুধু ঈর্ষার কারণ হতে পারে।
হিন্দুস্থান টাইমস (২৪ অক্টোবর, ২০২০) লিখেছে, ‘বাংলাদেশ: বাস্কেট কেস থেকে শক্তিশালী অর্থনীতি।’ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় তা এখন মনোযোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিগত ২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাবাহিক অগ্রগতি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে উন্নয়ন মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (১৬ অক্টোবর ২০২০) ব্যাখ্যা করেছে কেন বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জিডিপির তুলনায় বেশি নজর কেড়েছে। অর্থনীতির বাইরেও বাংলাদেশের ধারাবাহিকভাবে দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণ হলো গত দুই দশকে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সূচক যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, রাজনীতিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফরচুন ম্যাগাজিনের (৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯) ইন্ডিয়া সংস্করণে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে, ‘বছরের অর্থনৈতিক মিরাকল।’ উচ্চ প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে জেন্ডার অসমতা দূরীকরণ; সব ক্ষেত্রে যদি কোনো দেশ প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে থাকে সেটি হলো বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় শক্তি হিসেবে ধরা হয়েছে কর্মজীবী নারীদের। কারণ জেন্ডার সমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে হার মানিয়েছে। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারতে ২০ ও পাকিস্তানে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ যে এগিয়েছে নারীর কর্মক্ষেত্রে অধিক অংশগ্রহণ অন্যতম কারণ।
স্টিফান ডারকন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক পলিসির অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর ব্রিটিশ বৈদেশিক সহায়তা সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টে (ডিএফআইডি) প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি তিনি একটি বই লিখেছেন, ‘গ্যাম্বলিং অন ডেভেলপমেন্ট: হোয়াই সাম কাউন্ট্রিজ উইন অ্যান্ড আদারস লুজ।’ এ বইয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে যার নাম ‘দ্য বেঙ্গল টাইগার কাব’।
এতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বিগত তিন দশকের মধ্যে উন্নয়নশীল বিশ্বে অন্যতম সফল গল্পগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেক ভালো করেছে যেমন যথার্থ সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, গার্মেন্টস শিল্প কিংবা প্রবাসে কর্মজীবী পাঠানোর সুযোগের ক্ষেত্রে বহির্মুখী প্রবণতাকে উৎসাহ দেয়া। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন সম্ভব হয়েছে। তিনি অধ্যায়ের শেষ বাক্যে বলেছেন, ‘হতে পারে আগামীতেও বাংলাদেশ আমাদের প্রতিনিয়ত অবাক করে দিতে থাকবে।’
স্টিফান ডারকন - এর সাথে আমরাও আশাবাদী আগামীতে বাংলাদেশ বিশ্বকে অবাক করে দেবার মত কিছু করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ঠিক তেমনি স্মার্ট বাংলাদেশও স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নেবে। নিশ্চয়ই দেশ একদিন স্মার্ট বাংলাদেশ হবে।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জিকেএস