এ কোন মুক্তচিন্তা, ধর্মকে গালাগালি?


প্রকাশিত: ০৬:১০ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

যা ইচ্ছে তা বলতে পারার, লিখতে পারার অধিকার যদি মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হয়; হবে তা শ্লীল কি অশ্লীল বলতে পারার অধিকার কেন মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হবে না, তা বড় মুশকিল। সবচেয়ে বড় মুশকিল, ‘তথাকথিত প্রগতিশীল’দের নিয়ে। যাদের সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদীদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুটো দলই কট্টরপন্থি, দুধরনের মৌলবাদী, উগ্রবাদী। রক্ষণশীল তো বটেই। এদের ধারণা কোনোভাবে ধর্মকে অগ্রাহ্য করা, অস্বীকার করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, রঙ্গরস করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা, গালি দেওয়ার মধ্যেই জগতের তাবৎ আধুনিকতা!

কিছু লোক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ওপর রীতিমতো হামলে পড়েছেন। তিনি অপ্রগতিশীল, অবিজ্ঞানমনস্ক, মৌলবাদী, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করেন না, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় তার বিশ্বাস নেই- মুখে যা আসে, যা ইচ্ছে হয়, যা যা বলতে পারা যায় তার সবই বলছেন, বাদ রাখছেন না কিছুই। এটাই সম্ভবত তাদের কাছে সবচেয়ে বড় মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যে, যখন তখন যে কারও চরিত্রহনন করতে পারা।

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের অন্যায়টি কী? অপরাধ কোথায়? যতদূর জানি, ‘অখ্যাত ব-দ্বীপ প্রকাশনা’ থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি যার বিক্রি বন্ধ করেছে। একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বইটি থেকে কিছু অংশ মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে পড়ে শুনিয়েছেন। তিনি কিছু অংশ শোনার পর, তিনি শুনতে চাননি বাকিটা। তার কাছে খুব অশ্লীল মনে হয়েছে। মনে হয়েছে অশালীন। শুধু তাই নয়, তিনি লেখালেখির সময় ‘সতর্ক’ থাকতে বলেছেন। বলেছেন, কারও এমন কিছু লেখা উচিত নয়, যাতে অন্যের ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। বইটি পড়তে নিরুৎসাহিতও করেছেন তিনি। সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি মুক্তচিন্তার পক্ষে, আবর্জনার পক্ষে নন।

তার কাছে যদি ‘অশ্লীল’ মনে হয়, ‘অশালীন’ মনে হয়, ‘আবর্জনা’ মনে হয়- তিনি তো তা প্রকাশ করতেই পারেন। সেটি পড়তে বারণ করাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই অধিকার শুধু তার কেন, প্রতিটি মানুষেরই থাকা উচিত। ফেসবুকজুড়ে তোলপাড়, কেউ কেউ চিৎকার করছেন, আমার আবর্জনা পড়ারও অধিকার থাকা উচিত। আমার কথা হচ্ছে, বাজারে তো পর্নো পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। যেখানে অসুস্থ যৌন সম্পর্কের তাবৎ রগরগে গল্প থাকে। লোকে সেসব পড়ে  এক ধরনের যৌন পুলকও বোধ করেন। তাই বলে কী প্রকাশ্যে যে কোনো আবর্জনা বিক্রি হতে হবে? বাংলা একাডেমি বা সরকার তা প্রকাশ্যে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেবে? বিপণনে সহায়তা দেবে?

আজকাল এক অদ্ভুত ধরনের প্রগতিশীলতার মুখোশ দেখা যাচ্ছে। ধর্মকে যুক্তিহীনভাবে গাল দাও, তুমি আধুনিক। আক্রমণ করো, তুমি প্রগতিশীল। ধর্মীয় মনীষীদের চরিত্র হনন করো, তুমি বিজ্ঞানমনস্ক! ‘গালি’ শেষ পর্যন্ত গালিই। নোংরা আজেবাজে গালিগালাজকে অন্য কোনোভাবে দেখবার সুযোগ নেই। কেননা, আমি এখনও বিকারগ্রস্ত হয়ে যাইনি যে, গালিগালাজকে সমর্থন করব। কোনো গালি পৃথিবীর কোথাও আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞানমনস্কতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে- জানা নেই আমার। আলোচনা হতে পারে, সমালোচনা হতে পারে, তর্কও হতে পারে। কিন্তু ‘গালাগালি’ কখনও, কোনো সমাজে সভ্য ভদ্রলোকের কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না, হওয়ার কারণও নেই।
 
মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিদার ‘তথাকথিত প্রগতিশীল’দের বেশকিছু সাইট আমি পড়েছি। ব্লগও পড়েছি। এসব ‘তথাকথিত’ মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, বিজ্ঞানমনস্কদের লেখা পড়ে মনে হয়েছে এরা অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত রীতিমতো। তাদের লেখার সবটাজুড়েই গালাগালি। না আছে কোনো তথ্যউপাত্ত, না আছে কোনো সুনির্দিষ্ট যুক্তি। প্রায় প্রতিটি লেখাতেই ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, যৌন প্যারোডি। মনে হয়েছে এরাও আরেক ধরনের সাইকোপ্যাথ।

বিশ্বাস যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে লোকটি বিশ্বাসী তাকে জোর করে অবিশ্বাসী বানাতে চাওয়া, হাসি-তামাশা করা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কি মুক্তচিন্তা? এসব কি কোনো সুস্থ স্বাভাবিক সভ্য মানুষের লক্ষণ? সাইট ও ব্লগগুলোর নাম ও লেখার শিরোনাম আমি উল্লে­খ করতে চাই না, কেননা, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতো আমারও কয়েক লাইন পড়ার পর বিবমিষার উপক্রম। সত্যি সত্যিই যে কোনো স্বাভাবিক লোকের বমি চলে আসার উপক্রম হওয়া স্বাভাবিক। ধর্মকে গালি দিলেই আধুনিক হয়ে গেলাম- এ  নিন্মমানের চিন্তা যদি কারও মাথায় ঢুকে থাকে, তবে আমি মনে করি, তারচেয়ে বড় মূর্খ ও মৌলবাদী আর নেই। তবে তার বিপরীতে যারা প্রাণনাশ করে বা প্রাণনাশের হুমকি দেয় সেটিও ভয়াবহ অপরাধ ও অন্যায়।

লক্ষ্য করে দেখবেন, অনেক তাত্ত্বিক আছেন, যারা অবিশ্বাসী, যারা কোন ধর্মেই বিশ্বাস করেন না, কিন্তু কখনো কি দেখেছেন তারা গালিগালাজ করছেন বা করেছেন ধর্মকে। স্টিফেন হকিংন্স বা হার্ভাডের রিচার্ড ডকিন্স ধর্মকে অশ্লীল ভঙ্গি বা ভাষায় গালাগাল করেছেন এমনটি বোধহয় দেখাতে পারবেন না কেউই। এমনকি বারট্রান্ড রাসেলও কখনও এমনটি করেননি কোনোদিন। তাহলে এখানে যারা ধর্ম নিয়ে, মানুষের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে রসরসিকতা করছে, গালিগালাজ করছে এরা কারা? সহজভাবে বললে ‘অ-সভ্য’ মানুষ ছাড়া আর কেউ নয়।

জগৎ বিশাল ও বিচিত্র। মানুষের ধর্ম বিশ্বাসও তাই। যে যার মতো ধর্ম পালন করবে, করুক। আমি আপনি কেন তা নিয়ে কু-মন্তব্য করব, অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ব। ধর্মতো বিশ্বাসের বিষয়। এখনও অনেক অ্যাথনিক সোসাইটি রয়েছে, যেখানে মানুষ সূর্যের উপাসনা করে, পাহাড় প্রকৃতির উপাসনা করে, তার কাছে এটাই তার ধর্ম। আমার কী কোনো অধিকার আছে, না থাকা উচিত এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে তামাশা করার? সত্যিই যদি উদার হই, আধুনিক হই, শিক্ষিত হই, অন্যের প্রতি সম্মান থাকে, থাকে নিজের প্রতি- তাহলে কেন অন্যের ধর্ম বিশ্বাস আর অনুভূতিতে আঘাত করব?

যারা মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আক্রমণ করছে, হেনস্থা করছে উপর্যুপরি হয়রানি করছে- মূলত তারাই অশ্লীল, অবিজ্ঞানমনস্ক, অপ্রগতিশীল। কেননা, একমাত্র মূর্খই বুঝতে পারে না গালাগালির সঙ্গে মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিজ্ঞানমনস্কতার কোনো সম্পর্ক নেই।

লেখক : উপসম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।