সাশ্রয়ী জনবান্ধব গণপরিবহন হোক মেট্রোরেল
গাড়ি একটু নড়ছে তো নড়ে না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কতটুকু এগিয়ে আবারও একেই দশা। এই হলো নিত্যদিনের ঢাকার পরিস্থিতি। যানজট আর যানজট। যেই সময়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় পৌঁছা যায় কিংবা বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা যায়, সেই একই সময় নিয়ে ঢাকার ভেতর দিয়ে উত্তরায় যাওয়া যায় না।
আশুলিয়ার রাস্তায় গেলে মনে হবে জাহান্নামের চৌরাস্তা আর বাকি নেই। এক দশক আগের দিনগুলোতেই যদি ফেরা যায় যাত্রাবাড়ীর কথাই ধরুন। বাসে ওঠা কি মুশকিলটাই না ছিল! অফিসিয়াল সময়ে তো ওঠাই যেত না। ওই সময়ের সকালগুলো একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো জোগাড়।
মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার বাস্তবায়ন হওয়ার পরে সেই ভোগান্তি লাঘব হয়েছে, মানুষ আছান পেয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ আর হয় না। এখন যা হয় তা হলো ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে বাতাসের বেগে হু হু করে বাসের ছুটে চলা। যাত্রাবাড়ী-দোলাইপাড়-টিকাটুলির যানজট রাতারাতি নাই হয়ে যাওয়া।
গত রমজানের সময়টা অনেকেরই মনে থাকার কথা। সবগুলো অফিস একসাথে ছুটি হয়ে যেত। সবাই প্রতিযোগিতায় ছুটতো ইফতারিটা বাসায় গিয়ে পরিবারের সবার সাথে করার জন্য। পরিণাম আমরা সবাই জানি। একদিকে বাস ধরা যেমন মহা মুশকিল। ঠিক অন্যদিকে ঢাকার বাকি সব রাস্তার কথা বাদ দিলাম, বঙ্গভবনে সামনে দিয়ে মতিঝিলের দিকে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একেই স্থানে একটানা দু-দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা।
নিরুপায় হয়ে সময় তো যা অপব্যয় হওয়ার তা হয়েছেই, কিন্তু শ্রান্ত-ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত চেহারায় সর্বশেষ বিরক্তির আভাস। মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া। উল্টো দিকে যানজট সামলাতে সামলাতে ট্রাফিক পুলিশের হিমশিম খাওয়া। নাজেহাল এই অবস্থা যে কেবল রমজানের সময়ই ঘটে তেমনটা কিন্তু নয়। ঢাকার যোগাযোগ হালচাল সার্বক্ষণিক অন্ধকারেই ঢাকা। রমজান মাস উদাহরণ মাত্র। এই জটাজটি থেকে বের হতে চাইলেই বের হওয়ায় যায় না। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন। মেট্রোরেল তেমনই একটি প্রকল্প। এর সাথে সরাসরি সময়ের হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি আছে অর্থনীতির যোগ-বিয়োগ।
যানজট যতো কমবে যোগাযোগ তত গতিশীল হবে। এই হলো বাস্তবতা। যোগাযোগে গতিশীলতা পেলে, গতিশীলতা পাবে অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রার মান। মেট্রোরেলের ছোঁয়ায় মিরপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন। অনুভূত হচ্ছে অর্থনীতির চাকা নতুনভাবে জেগে ওঠার রব। আগারগাঁও পর্যন্ত আপাতত উদ্বোধন হলেও মতিঝিল কিংবা কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রো চলতে লাগবে আরও কিছু সময়।
পরিকল্পনার শুরুতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত হওয়ার কথা ছিল। তৎপরবর্তীকালে কমলাপুর পর্যন্ত বাড়িয়ে মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ২১.২৬ কিলোমিটার। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে অবকাঠামো নির্মাণের সময়। ব্যয় আরও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা’র থেকে নেওয়া ঋণ ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ। ব্যয়ের বিপরীতে আয়ের মাধ্যম হচ্ছে টিকিট এবং এমআরটি পাস বিক্রি। একজন ব্যক্তি মেট্রোরেলে উঠতে হলে তাকে সরাসরি টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে অথবা দরকার পড়বে এমআরটি পাস।
প্রতিটি এমআরটি পাসের দাম ৫০০ টাকা। এর মধ্যে কার্ডের জামানত ২০০ টাকা, বাকি ৩০০ টাকা ব্যালেন্স। এই ব্যালেন্সের মাধ্যমেই ভ্রমণ করা যাবে। ভ্রমণ খরচ হবে কিলোমিটারে ৫ টাকা, কিন্তু সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে ২০ টাকা। সেই হিসেবে উত্তরা থেকে মতিঝিলের ভাড়া ১০০ টাকার মতো। যদিও পরে কখনো কার্ড জমা দিলে জামানতের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলেছে সরকারপক্ষ। কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখুন তো বাসে যে পথের ভাড়া মাত্র ৪০ টাকা; সেই একেই পথে মেট্রোতে চড়লে গুনতে হবে ১০০ টাকা!
আবার লাগবে এমআরটি কার্ড। স্পষ্টভাবে পরিষ্কার যে এমআরটি পাসে প্রথমবার ভ্রমণে গুনতে হবে প্রায় ৫০০ টাকার নোট। পরে প্রতিবার ভাড়া হবে ১০০ টাকা হলেও ৪০ টাকা পথ ভ্রমণের জন্য সাধারণ মানুষ কি তাহলে এই মেট্রোরেলে চড়তে আগ্রহী হবে? হবে না। অর্থনৈতিক কারণে সর্বসাধারণ যদি আগ্রহী হয়ে না ওঠে তবে যে কারণে এই অবকাঠামোর নির্মাণ সেই লক্ষ্য তো গোড়াতেই বেহাত হয়ে গেলো!
উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনো জিনিস উৎপাদন খরচ এবং লাভের বিষয় চিন্তা করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শতভাগ নিশ্চয়তা থাকার পরও কেউই ওই ধরনের কোনো উৎপাদন বা অবকাঠামো ব্যবস্থা নির্মাণ করে না। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা তথ্যের ভেতরে দেখা যায় পরিচালনা ব্যয় ঠিকঠাক উঠবে কি না তা নিয়েই তাদের ভেতরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে।
মেট্রোরেলের বদৌলতে সময় বাঁচবে এটা সত্য। এই সময়কে যদি অর্থের অঙ্কে পরিমাপ করা হয় অথবা পারিপার্শ্বিক ব্যবসা বাণিজ্যের নানান দিক পর্যালোচনা করা হয় তবে হয়তো ক্ষতিপূরণ কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কতটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে অথবা যাবে না এটা পুরোপুরি নির্ভর করবে সাধারণ জনগণ এটাকে কতটা ব্যবহার করবে। কিন্তু এমন এক অর্থনৈতিক হিসাব-কিতাব ব্যবস্থা সামনে খোলাসা করে দিয়েছে যে এতে রাষ্ট্রীয় শ্রেণি বৈষম্য গভীরভাবে স্পষ্ট হয়েছে। এতো কিছুর ফলাফলে খবর এসেছে একদিনেই মেট্রোরেলের আয় কমেছে আড়াই লাখ টাকা। এক মেট্রোরেল করতে গিয়ে ঐতিহ্য স্থাপনা যা ধ্বংস করার তা তো গেছেই; সামনের দিনে হয়তো আরও বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া আমাদের বাকি আছে! দ্বিতীয়বারের মতো পরিস্থিতি ভাবতে হবে। মোটকথা বিদ্যুৎ খরচের বিষয়টা মাথায় রেখে সেবার দাম কমিয়ে চাহিদা বাড়িয়ে লাভজনক তত্ত্বে হাঁটার সময় এখন।
যানজটের এই ঢাকার শহরে মেট্রোরেলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউ দ্বিমত করবে না। বরং এরকম একটা যানবাহন আমাদের দরকার ছিল আরও দু’চার দশক আগেই। প্রশ্নের জায়গাটা কেবল অর্থনীতিতে, অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের স্বচ্ছতায়। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভ্যাট ট্যাক্সের পয়সায় করা হলেও অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে তারা চড়তে পারবে না দুঃখটা এখানেই।
শ্রেণিবৈষম্য তো প্রকটা আকারে বেরিয়ে পড়ছেই; অধিকন্তু সর্বজন যদি না ব্যবহার করতে পারে তবে যানজট নিরসন হওয়া সম্ভব নয়। কর্তৃপক্ষের সুমতি কাম্য, যা হোক শেষ পর্যন্ত মেট্রোরেলের হুইসেল বাজছে সেটাই অনেক। এ হুইসেলে শুনতে পাচ্ছি একাত্তরের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের শত আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ঢাকা।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস