ভালোবাসার দিন


প্রকাশিত: ০৪:০৭ এএম, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

শুক্রবার বিকেলে আমি সাধারণত রুগী দেখি না। সপ্তা শেষ হবার একটা আমেজ এসে যায়। সপ্তাহান্তের ছুটির জন্য আমার মনটাও হালকা হয়ে যায়।

আজ তা হোল না। আমার খুব কাছের একজন ডাক্তার বন্ধু তার বাবাকে নিয়ে আসবেন আজ বিকেলে। অফিসে ঢুকে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম। আমার ডাক্তার বন্ধু তার বাবা- মা, আর তিন ভাই বোন নিয়ে আমার জন্য বসে আছেন। তার বাবার বয়স আশির কাছাকাছি। এখনো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেন। আর তার মা কে দেখলে কেউ বলবে না যে তিনি সত্তুরের উর্ধ্বে।

আমার বন্ধুর  বাবা মা থাকেন অ্যালাব্যামার ছোট্ট একটা শহরে। বাবা মা দুজনেই ছোট্ট সে শহরের একমাত্র কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। সময় পেলে এখনও চাষাবাদ করেন নিজেদের ছোট ফার্মে। তাদের এক মেয়ে আইনজীবী। আর এক ছেলে অ্যালাব্যামার একটি শহরের মেয়র। ভদ্রলোকের জীবনের ইতিহাস বড় রঙিন। বাবা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ কৃষক, মা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মেয়ে। আমেরিকার বর্ণবাদের অন্ধকার দিনগুলোর অনেক চড়াই উৎরাইয়ের সাক্ষী তারা। তিনি অত্যাচারিত হয়েছেন নিজ পরিবারের কাছে, বন্ধুর কাছে, সমাজের কাছে। অত্যাচার সইতে না পেরে শহর ছেড়ে ছলে গিয়েছিলেন বোস্টনে। সাথে ছিল সদ্য বিবাহিতা কৃষ্ণাঙ্গ স্ত্রী। দু যুগ পর তারা ফিরে গিয়েছেন নিজ শহরে। স্কুল করেছেন, কলেজ করেছেন, ছাত্র পড়িয়েছেন। ছেলে মেয়েদের মনের মতো বড় করেছেন।

গত তিন মাস ধরে তাঁর ওজন কমছে। খিদে নেই। কোনো রোগ ব্যাধি নেই বলে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। ছেলে জোর করে ধরে এনেছেন বাবাকে। সপ্তার শুরুতে তাঁকে দেখেছি, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর দেখা গেল তাঁর অগ্নাশয়ে ক্যান্সার হয়েছে এবং তা লিভারসহ নানা জায়গাতে ছড়িয়ে গেছে। আজ আমাকে দুঃসংবাদটা তাঁকে আর পুরো পরিবারকে জানাতে হবে।

রোগীকে দুঃসংবাদ দেয়াটা আমার সবচে অপছন্দের কাজ। তারপরও এ কাজটা প্রায়ই করতে হয়। আমি সাধারণত আগে থেকেই রোগীকে বলি তাঁর প্রিয়জনকে সাথে করে নিয়ে আসতে। আমি দেখেছি এটা আমার কাজকে অনেকটা সহজ করে দেয়।
দীর্ঘ সময় নিয়ে তাঁদের সব কিছু খুলে বললাম। ওদের সবার চোখে পানি। আমার চোখেও পানি। ভদ্রলোক তাঁর ষাট বছরের প্রিয় জীবনসঙ্গীর হাত শক্ত করে ধরে আছেন। আমাদের কারো মুখেই কোন কথা নেই। তিনিই নীরবতা ভাঙলেন। নরম গলায় বললেন। “ ডাক্তার, আমি একটি চমৎকার জীবন কাটালাম। আমার আর কিছু পাবার নেই এ জীবনে। আমি একজন সুখী মানুষ। আমি কোনো কষ্টকর চিকিৎসা নিতে চাই না। জীবনের শেষ কটা দিন আমার ফার্মে কাটাতে চাই। আমার কাছের মানুষগুলোকে দেখতে চাই। শেষ কটা দিন আমার কলেজের কচি মুখগুলোকে জীবন সম্পর্কে বলতে চাই।”

এর আগেও আমি  এরকম সুখী মানুষের তৃপ্ত জীবনের গল্প শুনেছি। এদের কাছে জীবন মৃত্যুর সেতুটা বড় চেনা, বড় সহজ।
খুব কম মানুষই বুকে হাত রেখে বলতে পারে, “ আমি একজন সুখী মানুষ, আমার জীবন পূর্ণ”।

চারদিকে ভ্যালেন্টাইন ডের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। গাড়িতে করে ঘরে ফিরছি। ভালোবাসার দিনটি এবার কেমন কাটবে এ চমৎকার মানুষটির? এসব ভাবতে ভাবতেই রবিঠাকুরের গান শুনছি-
“ আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।”

ভালোবাসার দিনটি স্বর্গীয় আনন্দে ভরে উঠুক সবার।   

লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।