রাসেল আমার ভালোবাসা

আজ ১৮ অক্টোবর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন। দিনটি অন্যান্য দিনের মতো সাধারণ হলেও জাতির জন্য অনন্য।

১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন শেখ রাসেল। একটি সম্ভাবনার অঙ্কুরোদগমের আগেই, বিনষ্ট করে দিলো পাকিস্তানি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ এদেশীয় কিছু সেনা কর্মকর্তা। মাত্র ১১ বছর বয়সে চিরতরের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল একটি অমিয় সম্ভাবনার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আর এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে সেদিন রেহাই পাননি সেদিনের সেই কিশোর রাসেলও।

দৃঢ় প্রত্যয়ী, সাহসী ছোট্ট রাসেলকে পরিণত হতে দিলো না ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের খুনিরা। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের শঙ্কা ও ভয় এতটা ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাত্র চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শেখ রাসেলকেও হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। কিশোর রাসেল যদি বেঁচে থাকে তবে তাদের কোন একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সেই ধারণা থেকে হয়তোবা তাকে হত্যা করে খুনিরা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শেখ রাসেল। সবার ছোট হওয়ার কারণে রাসেলের আদর-সোহাগ-ভালোবাসার কমতি ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইটিতে শেখ রাসেলের জন্ম, নামকরণ, বেড়ে ওঠা ইত্যাদি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, যা আমার মতো পাঠক হৃদয়ে নাড়া দেয়। ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইটিতে শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন, ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ির আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন।

একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিলো রাত দেড়টায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এর মধ্যে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বইও পড়তেন। আর রাসেলের বই পড়ে মাঝে মাঝে ফজিলাতুন নেছাকে শোনাতেন। এসব শুনে ফজিলাতুন নেছা রাসেলের দর্শন-চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছোট ছেলের নাম রাখেন রাসেল।

বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিলে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে ১৯৬৬ সালের ৮ মে গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। কোনো রাজবন্দির সঙ্গে দেখা করতে হলে জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এ সময় ফজিলাতুন নেছা পরিবার নিয়ে বঙ্গন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে গোয়েন্দারা সবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন, এমনকি দেড় বছরের শিশু শেখ রাসেল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করায় ক্ষুব্ধ হন ফজিলাতুন নেছা। তখন তিনি বলেন,‘বাপের পেছনে গোয়েন্দা লেগেছিল ২৮ বছর বয়সে, কিন্তু ছেলের পেছনে লাগলো দেড় বছর বয়সেই।’

শেখ রাসেল বড় হতে থাকে। বইটিতে শেখ হাসিনা আরও উল্লেখ করেছেন, মহান স্বাধীনতার বছরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার পর বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে ধানমন্ডির একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বাড়ির ছাদের ওপর দুদিকে দুটি বাঙ্কার করে মেশিনগান বসিয়ে পাহারা দিতো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। এসময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও বন্দি করে রাখা হয়। শেখ রাসেল এসময় পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কান্নাকাটি করতো।

তাছাড়া বড় দুই ভাই, বিশেষ করে শেখ কামালকেও পেতো না। এতে তার কষ্ট আরও বেড়ে যেতো। দিনরাত গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠতো শিশুরা। শেখ রাসেল পকেটে তুলা রাখতো। কারণ যখন বিমান হামলা ও গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠতো তখন কানে তুলা গুজে দেওয়ার জন্য। ভাগনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কানে তুলা গুঁজে দিত। যাতে গুলি কিংবা বিমান হামলার আওয়াজে কানের পর্দা ফেঁটে না যায়। বিমান হামলার সময় শেখ রাসেল অস্থির হয়ে যেত। তখন সে ছুটে বারান্দায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করতো। তখন তাকে জোর করে ধরে রাখতে হতো। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধুর পরিবার তথা রাসেলরা মুক্ত হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী এসে তাদের উদ্ধার করে।

শেখ রাসেলের জন্মের সময় পিতা শেখ মুজিব চট্টগ্রামের এক জনসভায়। এরপর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেশে ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করা, জেলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে শেখ রাসেল পিতা শেখ মুজিবকে খুব একটা কাছে পেতেন না। এরপর স্বাধীন দেশে বড় হতে থাকা শেখ রাসেল অন্য সাধারণ ছাত্রের মতো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। এসময় তাকে বাড়িতে পড়ানোর জন্য একজন গৃহ শিক্ষক রাখা হয়।

শেখ রাসেল গৃহশিক্ষককে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো সম্মান করতেন। পড়াতে আসলে গৃহশিক্ষককে দুটো মিষ্টি খেতে হতো, আর মিষ্টি না খেলে সে পড়তো না। এককথায় শেখ রাসেল অতিথিপরায়ন ছিলেন। শেখ রাসেল টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে গেলে ছোট ছোট শিশুদের জড়ো করে ডামি বন্দুক নিয়ে প্যারেড করাতো। এসময় প্যারেড শেষে তাদের খাবার কিনে দিতো এবং ঢাকা থেকে তাদের দেওয়ার জন্য কাপড় নিয়ে যেত। ছোট চাচা শেখ আবু নাসের তাকে এক টাকার নোটের বান্ডিল দিতেন, যা দিয়ে সে গ্রামের বন্ধু ও শিশুদের লজেন্স কিনে দিতেন।

বাবার সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো, পড়াশোনা, খেলার সাথীদের সঙ্গে খেলা করে বড় হচ্ছিল ছোট্ট রাসেল। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস ছোট্ট উচ্ছল কিশোরের জীবনটা একেবারেই ছোট থাকতেই শেষ করে দিলো খুনিরা। এমন দুরন্ত, তেজস্বী ও মানবিক এক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মুকুলেই ঝরে গেলো। আর এজন্য গোটা বাঙালি জাতি আজও ধিকৃত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ রাসেলের জন্মদিন জাতীয়ভাবে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

এছাড়া ১৮ অক্টোবর শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিতে জাতীয় পদক প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাকিস্তান ও বিদেশি মদতপুষ্ট দেশীয় কিছু নরঘাতকের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় বাবা-মা, ভাই-ভাবি, চাচাসহ পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে নিহত হন শেখ রাসেল। আজ এ চিরঞ্জীব ভালোবাসার শেখ রাসেলের জন্মদিনে অতল শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস