বিশ্ব ডিম দিবস

প্রতিদিন একটি ডিম পুষ্টিময় সারাদিন

মো. সামছুল আলম
মো. সামছুল আলম মো. সামছুল আলম , লেখক, গণযোগাযোগ কর্মকর্তা
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০২২

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ডিম মানুষের জন্য মূল্যবান খাদ্যসামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ধারণা করা হয়, ৭ হাজার ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে ডিমের জন্য বন্য মুরগি পালন করা হয়। সুম ও মিশরে মুরগি আনা হয় ১৫শ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। এবং ৮শ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ডিমের জন্য মুরগি আনা হয় গ্রিসে।

ডিম সম্পর্কে নানা কুসংস্কার থাকা সত্ত্বেও সহস্রাধিক বছর ধরে মানুষ ডিম খেয়ে আসছে। দুনিয়ার সব জাতি, ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে ডিম একটি সহজলভ্য ,সাশ্রয়ী ও গ্রহণযোগ্য খাবার। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর ডিম পাওয়া যায়। তবে সব থেকে জনপ্রিয় হচ্ছে মুরগির ডিম। ডিম খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সব বয়সের মানুষ ডিম খেতে খুব পছন্দ করে।

ডিম বর্তমানে সারা বিশ্বে সুপারফুড নামে পরিচিত। এটি নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর। ডিমে রয়েছে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-২, ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন বি-৫, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, বায়োটিন, কোলিন, ফলিক অ্যাসিড, আয়োডিন, আয়রন, ফসফরাস, সেলেনিয়ামসহ ১৩টি ভিটামিন ও মিনারেলস এবং ৬ গ্রাম উন্নতমানের প্রোটিন। ডিমের নানা পুষ্টিগুণের মধ্যে অন্যতম প্রোটিন। এই প্রোটিনে রয়েছে নয়টি জরুরি অ্যামাইনো অ্যাসিড। এটি পেশি গঠন, মজবুত ও পুনর্গঠনে সাহায্য করে। তাছাড়া ডিমে রয়েছে ভিটামিন ও মিনারেল, যা কি না মস্তিষ্কের সেল গঠনে সহায়তা করে। ফলে সুস্থ মস্তিষ্ক গঠন করে। এছাড়া ডিমে থাকা ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-১২, সেলেনিয়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

কিছুদিন আগেও হৃদরোগের ক্ষেত্রে ডিমের ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা বলছে প্রতিদিন একটি ডিম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যেতে পারে অনেকটাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিমের কিছু পুষ্টি উপাদান গর্ভাবস্থায় খুব জরুরি। বিশেষ করে ডিম জন্মগত ‘স্পাইনাল বিফিডা’ রোগের ঝুঁকি কমায়। ডিমে থাকা লুটেইন ও জিয়েক্সাথিন দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখে নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। তাছাড়া ডিমের অন্যান্য ভিটামিনও ভালো দৃষ্টিশক্তির জন্য সহায়ক।

এছাড়া স্থুলকায় মানুষের জন্যও ডিম উপকারী। ডিম খেলে দীর্ঘ সময় ক্ষুধা লাগে না। সেই সঙ্গে এনার্জিও পাওয়া যায়। যেহেতু ক্ষুধা লাগে না তাই বাড়তি খাবার খাওয়া কম হয়, ওজন কমে। অন্যদিকে ডিমে বিদ্যমান বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল ত্বক সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সুন্দর ত্বকের জন্য সুষম খাদ্যাভ্যাস, সঠিক পুষ্টির দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, সপ্তাহে ছয়টি ডিম খেলে স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ কমে আসবে। শর্করা কমিয়ে প্রতিদিন ডিম খেলে মাসে ৩ পাউন্ড ওজন কমানো সম্ভব। মাত্র দুটি ডিম নারীর দৈনিক প্রোটিন চাহিদার এক-চতুর্থাংশ পূরণ করতে পারে।

পাওয়ার হাউজ অব নিউট্রিশন নামে পরিচিত এই ডিম সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে অন্যান্য বছরের মতো এবারো বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। ‘প্রতিদিন একটি ডিম পুষ্টিময় সারাদিন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ১৪ অক্টোবর শুক্রবার পালিত হবে দিবসটি। প্রতিপাদ্য অনুযায়ী শিশু-কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক সবার সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন একটি ডিম দরকার। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ডিমের ব্যবহার অপরিহার্য। কেননা আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

শিশুরা সমাজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে একটি ডিম খেলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। তাই বাড়ন্ত বয়সের শিশুদের জন্য ডিম খুবই উপকারী খাবার। ডিমে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। অপুষ্টির শিকার শিশুরা খর্বাকৃতির হতে পারে।

এসব শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম হয়। ৬ বা ৯ মাস পর থেকে শিশু যদি একটা করে ডিম খায়, তাহলে শিশুর খর্বাকৃতি কমাতে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে শিশুর জন্মের পর থেকে ১ হাজার দিন পর্যন্ত ডিম খাওয়া খুবই প্রয়োজন। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ শতাংশ শিশু কৃশকায় অর্থাৎ এরা তীব্র অপুষ্টির শিকার।

পাশাপাশি একই বয়সী ৩০ শতাংশ শিশু খর্বকায়, অর্থাৎ বয়সের তুলনায় এদের উচ্চতা কম। অন্যদিকে ২ শতাংশের বেশি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন সময়ের শিশু পুষ্টির যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কৃশকায় ও খর্বকায় শিশুর হার দিন দিন কমছে, তবে অস্বাভাবিক বেশি ওজনের শিশুর হার বাড়ছে।

নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর এ ডিমকে বিভিন্ন ধরনের রেসিপি তৈরি করে খাওয়া যায়। ডিম ভাজা, পোচ, সিদ্ধ, আধা সিদ্ধ করে খাওয়া ছাড়াও কেক, প্যানকেক, হালুয়া, স্যান্ডউইচ, সালাদ, চপ, পুডিং, বিরিয়ানি, নুডলস, পিঠা ইত্যাদিতে ব্যবহার করে খাওয়া যায়। ডিমকে বিশ্বে একটি উন্নতমানের ও সহজলভ্য আমিষজাতীয় খাদ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন (আইইসি) স্থাপিত হয়।

প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন, মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক উপাদান ডিমের পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম পালিত হয় ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। তখন থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার এ দিবসটি বিশ্বজুড়ে একযোগে পালিত হয়ে আসছে। ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ডিম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশনের (আইইসি) সাথে তাল মিলিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিবসটি পালন করে আসছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারতসহ সারা বিশ্বের ৬০ টিরও বেশি দেশে পালিত হয় ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। এবং এর পরিধি ও ব্যাপ্তি সময়ের সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এই সংস্থাটির সদস্য ৮০টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ অ্যানিমেল এগ্রিকালচার সোসাইটি (বিএএএস) ‘ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশন’র বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়।

বিশ্ব ডিম দিবসের তাৎপর্যকে বহন করে বাংলাদেশের গবেষক ও চাষী এবং খামারিদের আপ্রাণ চেষ্টায় ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পরামর্শ হলো, সুস্থ থাকার জন্য প্রত্যেক মানুষের বছরে অন্তত ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর সংস্থার গবেষণা ও খামারিদের পরিশ্রমের ফলে দেশে ডিমের মোট উৎপাদন ছিল ২ হাজার ৩৩৫ দশমিক কোটি। ফলে বছরে জনপ্রতি ডিমের প্রাপ্যতা বেড়েছে ১৩৬ দশমিক ০১টি। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ৪৯৩ দশমিক ৩১ কোটি। যদিও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার ও সিন্ডিকেটের অতিমুনাফালোভী মনোভাবের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ডিম ক্রয়ের সক্ষমতা।

এ ধরনের প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডিম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে একদিকে মানুষের পুষ্টি চাহিদা যেমন পূরণ হবে অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্রতা দূর করে কর্মসংস্থানের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি ডিম নিয়ে আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ও মানুষের মধ্যে ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে দেশের আপামর মানুষ যদি পরিমাণ মতো ডিম খায় তবে অপুষ্টির চিত্র পুরোপুরি পাল্টে ফেলা সম্ভব হবে।

লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

বছরে জনপ্রতি ডিমের প্রাপ্যতা বেড়েছে ১৩৬ দশমিক ০১টি। যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদন হয়েছিল ১ হাজার ৪৯৩ দশমিক ৩১ কোটি। যদিও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার ও সিন্ডিকেটের অতিমুনাফালোভী মনোভাবের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ডিম ক্রয়ের সক্ষমতা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।