রম্য

বউ বিভ্রাট

মোকাম্মেল হোসেন
মোকাম্মেল হোসেন মোকাম্মেল হোসেন , সাংবাদিক, রম্যলেখক
প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে মেলা হুজ্জত- এটা বাসররাত থেকেই টের পাচ্ছে বশির মিয়া। বশিরের সুন্দরী স্ত্রী রুমা বেগম কখন হাসবে, কখন কাঁদবে কিংবা কখন কী বায়না ধরে বসবে, তা দেবতাদেরও অগোচর। বায়নার আয়নায় নিজের অসহায় মূর্তি দেখে বশির হয়তো বলে-

: তর মাথায় কি ছিট আছে?
কাচ-ভাঙা হাসি হেসে রুমা বেগম তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়-
: হ আছে; আমার মাথায় ছিট আছে, পীরিতের ছিট।

এই একটা ক্ষেত্রে বশির মিয়া খুবই দুর্বল। রুমা বেগম যতবার তার টইটম্বুর প্রেমসরোবরে বশিরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়, ততোবার সেই শীতল জলে অবগাহন করতে করতে বশির প্রতিজ্ঞা করে-ভালোবাসার মূল্য সে ভালোবাসা দিয়েই শোধ করবে।

ভালোবাসার দাড়িপাল্লায় প্রেমের বাটখারা দিয়ে কেউ যদি তার প্রিয়জনের দোষ-গুণ পরিমাপ করতে বসে, তাহলে সেই প্রিয় মানুষটির গুণের পাল্লাই ভারী হয়ে উঠবে। বশির মিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটে না। রুমা বেগমের ব্যাখ্যাহীন আচরণ কখনো কখনো তার কাছে অসহনীয় মনে হয়, বিরক্তিকর ঠেকে; কিন্তু তারপরও স্ত্রীকে সে প্রাণের অধিক ভালোবাসে।

হাটবার হওয়ায় রুমা বেগমকে বিছানায় রেখেই খুব ভোরে পানের বরজে গিয়ে এক খাচা পান তুলে এনে বারান্দার এক কোণায় বসে গুণে গুণে ‘বিড়া’ তৈরি করছিল বশির, এমন সময় মায়ের গলা শুনতে পেল সে। বশিরের মা মৌরণ বেওয়া জানতে চাইলেন-

ও বশু, বউ কান্দে ক্যা?
: ক্যামনে কই!
: ক্যামনে কই মানে? তুই কিছু কইছস?
না।
: তাইলে কান্দে ক্যা?
: কী মুশকিল! ঘুম থেইক্যা উইঠ্যাই আমি পান ভাঙবার গেলাম। পাটেশ্বরী কী জন্য কান্দে, আমি ক্যামনে কমু?
রোদন-রহস্য উদ্ঘাটিত হলো হাটে যাওয়ার আগ মুহূর্তে।

রুমা বেগমের বক্তব্য হচ্ছে-রাতে ঘুমিয়ে সে স্বপ্নে দেখেছে, তার মা তার কাছে পানি খেতে চাচ্ছেন। এর ব্যাখ্যা সে করেছে এভাবে-যে কোনো কারণেই হোক, তার মা তাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। তা না হলে স্বপ্নযোগে পানির পিপাসায় কাতর হওয়ার ছলে এই বার্তা পাঠাত না। খবর যখন পাঠিয়েছে, তখন অবশ্যই যেতে হবে- এই হচ্ছে রুমা বেগমের ক্রন্দন বৃত্তান্ত।

বশির তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, রুমা বেগম যখন তার বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য গোঁ ধরেছে, তখন সে যাবেই। কাজেই সাব্যস্ত হলো-বশিরের ছোট ভাই কসির বিকেলের ট্রেনে রুমা বেগমকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি নান্দিনা যাবে। বশির যেতে পারছে না, কারণ তার ধলা গাইটা আসন্নপ্রসবা। একে ছেড়ে কোথাও নড়ার উপায় নেই তার।

বিদায়ের প্রাক-মুহূর্তে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বোকার মতো বশির স্ত্রীকে বলে-
: তুই তাইলে যাবিই?
: মানা করলে যামু না!
: মানা করলে যামু না, কী আমার না শুনলেওয়ালী রে!
: আপনে কবে যাবাইন, কন!
: আমার কুনু যাওয়া-যাওয়ি নাই।
: মাথার কিরা। কবে যাবাইন কন!
: কইলাম তো ...

রুমা বেগমের সংসর্গবিহীন দিন ও রাতের প্রতিটি প্রহর যে কী পরিমাণ কষ্টের, তা বশির বুঝতে পারে যখন রুমা বেগম ও তার মধ্যে বিরহকাল উপস্থিত হয়। রুমা বেগম চলে যাওয়ার পরদিন গোসল করতে গিয়ে বশির শুনল-পুকুরের জল কলকল শব্দে তাকে বলছে-

: মাথার কিরা, মাথার কিরা, মাথার কিরা।
পানের বরজে গিয়ে শুনল পানপাতারা গুঞ্জন তুলে বলছে-
: মাথার কিরা, মাথার কিরা, মাথার কিরা।
দুপুরে খেতে বসে শুনল-
: ভাত-তরকারিগুলো সব সমস্বরে হাহাকার করছে-
: মাথার কিরা, মাথার কিরা, মাথার কিরা।

এরকম অবস্থায় বরাবর যা করে, এবারও তাই করল বশির। ধলা গাইকে নিয়তির হাতে সঁপে দিয়ে বিকেলের ট্রেনে শ্বশুরবাড়ি রওনা হয়ে গেলো সে।
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে শ্বশুরবাড়ির আঙিনায় পৌঁছে বশির লক্ষ্য করল- মাচান থেকে লাউশাক তুলছে জনৈকা যুবতী নারী। যুবতীর পরনের চন্দ্রমল্লিকা প্রিন্ট শাড়ি দেখে সে নিশ্চিত হলো-এ তার রুমা বেগম। রুমা বেগমকে এমন একটা পরিবেশে পেয়ে রোমান্টিকতার ঢেউ আছড়ে পড়ল বশিরের হৃদয়-তটে। সে তখন চুপিচুপি রুমা বেগমের নিকটবর্তী হয়ে তার মরালসদৃশ গ্রীবায় চিমটি কেটে নিজের উপস্থিতি জানান দিল।

চিমটি যে দিল এবং চিমটি যে খেল-দুজনেই দুজনকে এক পলক দেখল এবং অতঃপর একজন জমে পাথর হয়ে গেলো আর অন্যজন দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল।
রুমা বেগম : কী অইছে বুবু?
ঝুমা বেগম : জামাই আইছে!
রুমা বেগম : জামাই আইছে ভালা কথা। তুমি এমুন ছোটাছুটি শুরু করছ ক্যা?
ঝুমা বেগম : একটা কাম বড় বেতাইল্যা অইয়া গেছে রে!
রুমা বেগম : কী কাম?
ঝুমা বেগম : বাইডিগের জাংলা থেইক্যা লাউয়ের ডুগা তুলতেছিলাম, জামাই আমারে তুই মনে কইরা ...
রুমা বেগম : তোমারে আমি মনে কইরা কি করছে? চিমটি দিছে?
ঝুমা বেগম : তুই বুঝলি ক্যামনে?
রুমা বেগম : আমার মানুষের কাজ-কাম আমি বুঝমু নাতো পাড়ার মাইনষ্যে বুঝব? হি-হি-হি...
ঝুমা বেগম : রঙ-ঢঙ্গ পরে করিস। অহন তর শাড়ি আমি খুইল্যা তরে দিয়া দিতাছি, এইডা পিইন্দা তুই জামাইর সামনে যা।

কিছুদিন আগে বশিরের কিনে দেওয়া চন্দ্রমল্লিকা প্রিন্ট শাড়ি শরীর বদল করে রুমা বেগমের গায়ে উঠল। হলুদ খয়েরি আর কলাপাতা রঙের মিশেল দেওয়া চন্দ্রমল্লিকা নামের সেই প্রিন্ট শাড়ি পরিহিতা রুমা বেগম সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে স্বামীর কাছাকাছি যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বশির কোনো দিকে না তাকিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে উঠল-

: আমারে মাফ কইরা দ্যান বুজান। আমি একটু বেদিশা অইয়া পড়ছিলাম।
: মাফ কইরা দিলাম।
: তুই?
: হ, আমি; উঠেন। আপনের জায়গা অইখানে না। আপনের জায়গা অইলো আমার বুকের মধ্যে...
এ কথা বলার পর রুমা বেগম হাসে সেই হাসি-যে হাসির জন্য বশির মিয়া তামাম দুনিয়া বন্ধক দিতে রাজি।

লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

কিছুদিন আগে বশিরের কিনে দেওয়া চন্দ্রমল্লিকা প্রিন্ট শাড়ি শরীর বদল করে রুমা বেগমের গায়ে উঠল। হলুদ খয়েরি আর কলাপাতা রঙের মিশেল দেওয়া চন্দ্রমল্লিকা নামের সেই প্রিন্ট শাড়ি পরিহিতা রুমা বেগম সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে স্বামীর কাছাকাছি যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।