রাত নিঝুম, দু’চোখে ঘুম আসে না
ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দতো নয় যেন কেউ মাথার ভিতর হাতুড়ি পিটা করছে। ডিম লাইটের আলোতে ঘরের প্রায় সবকিছুই স্পষ্ট। সিলিঙে ঝুলানো ফ্যানটা কি একটু আস্তে ঘুরছে আজ? না! এসব ভেবে ভেবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করার চেয়ে ওঠে পড়াই ভালো।
বিছানা ছেড়ে রিয়া এগিয়ে গেল রাস্তার ধারের জানালাটার পাশে। পর্দা সরিয়ে তাকালো বাইরে, যেন একটু খুঁজে দেখছে কোনো বাড়িতে এখনো আলো জ্বলছে কিনা। ঘুমন্ত শহরে জেগে নেই কেউ, গলির মোড়ের নাইট গার্ড বাঁশি বাজিয়ে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। রিয়া ভাবলো কী করা যায়? কীইবা করার আছে তার এই রাতে?
হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে রিয়া। ঘড়ির কাটা তিনটা ছুঁই ছুঁই। রাতের নিস্তব্ধতা যেন গিলে খাচ্ছে রিয়াকে। একোনো বিচ্ছিন্ন রাত নয়, দিনের পর দিন এভাবে বিনিদ্র রাত কাটায় রিয়া নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করে।
ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা হল এক ধরনের ঘুমের অবিরাম অস্বাভাবিকতা যা ব্যক্তির ঘুম আসতে বাধা দেয়, নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় অথবা একই সাথে ঘুম না আসা এবং ঘুমালে অল্প সময় পরেই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার মত উপসর্গ নিয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। যদিও এটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু তারপরেও সুনিন্দ্রাই নির্ধারণ করে ব্যক্তির সজীবতা, কাজ করার শক্তি ও স্পৃহা, মানসিক স্থিরতা, উচ্ছলতা এবং কাজের নৈপূণ্য ও জীবন যাপনের দক্ষতা।
কথায় আছে বিছানায় শোয়ামাত্রই যিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন, তিনিই পৃথিবীর সবচে সুখী ব্যক্তি। কথাটা একেবারে ফেলনা নয়। কারণ সুখ সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত সুস্থ দেহ সুস্থ মন- সবই নির্ভরশীল পরিপূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের ওপর। অথচ বহু মানুষ আছেন যারা প্রতিনিয়ত ভুগছেন নিদ্রাহীনতায়। আর প্রায়ই না বুঝেই অবহেলা করে বাড়াচ্ছেন জটিলতা। আপনি কি ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত- প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু তথ্য আর সমস্যটি সঠিকভাবে নিরুপণ করা সম্ভব হলেই সমাধানের পথে এগুনো যায়।
সাধারণত দুধরনের ইনসমনিয়া দেখা যায়- সাময়িক ইনসমনিয়া এবং দীর্ঘদিনের ক্রনিক ইনসমনিয়া। ইনসমনিয়া হওয়ার পেছনের প্রধান তিন কারণ আমাদের জীবনে সব সময় বিদ্যমান। কিন্তু এই তিন কারণকে মোকাবেলা করতে চাই মানসিক বল ও স্থিরতা। যেমন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি অনিদ্রায় ভুগতে পারেন। হতে পারে সম্পর্কের বা চাকরি ক্ষেত্রের কোনো দুশ্চিন্তা কিংবা কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে অস্থিরতা অথবা পরীক্ষাভীতি বা ফল প্রকাশের ভয়ে ব্যক্তির রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে পরপর কয়েকদিন বা বেশ অনেকদিন যদি অনিদ্রায় বা স্বল্পনিদ্রায় রাত কাটে তবে বিষয়টি ইনসমনিয়া বলে বিবেচিত হবে। হতে পারে তা সাময়িক কিন্তু অবহেলা করলে চলবে না।
তাছাড়া ইনসমনিয়ার আরেক কারণ শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা। শরীরে অসুখ নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ নেই কিন্তু মনের অসুখ যেন সবসময় উপেক্ষিত, কখনো বা তাচ্ছিল্যের শিকার। অথচ অনিদ্রার পেছনের কারণ হতে পারে এ দুইই। ঘুম আসে না বলে আমরা বিরক্ত হই কিন্তু কেন ঘুম আসে না তা প্রায়ই খুঁজতে যাই না।
আর তৃতীয় যে কারণটি ইনসমনিয়ার জন্য দায়ী তাহলো প্রাথমিকভাবে ঘুম না আসা। অর্থাৎ সামান্য কোনো কারণে হয়তো কয়েকদিন ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো বা বিনিদ্র রাত কাটলো কিন্তু তারপর ওই কারণ আর না থাকা সত্ত্বেও ঘুমের সম্যস্যাটি যদি রয়ে যায়। এক রাত দুরাত ঘুম না হলেই ইনসমনিয়ায় ভুগছেন তা ভাবার কারণ নেই। কিন্তু সত্যিই ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত অথচ বুঝতেই পারলেন না তাহলে আপনি আরো বড় সমস্যাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন জানবেন।
সাময়িক ইনসমনিয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে সাধারণত লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে অতিমাত্রায় বা অস্বস্তিকর শব্দ, ঘরের তাপমাত্রা আরামদায়ক না হওয়া, ঘুমানোর সরঞ্জাম যেমন বিছানা বালিশ আরামদায়ক না হওয়া, ঘরের পরিবেশ ঘুমের জন্য উপযোগি না মনে হওয়া, নতুন জায়গা বা হঠাৎ করে ভূপৃষ্ঠ থেকে উঁচু কোনো স্থানে যেমন পাহাড়ি এলাকায় অবস্থানের কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাছাড়া মানসিকভাবে চাপ অনুভব করলে সাময়িক অনিদ্রা দেখা দিতে পারে। যেমন পরীক্ষার চাপ, ভালোবাসার মানুষকে হারানো বা কাছের মানুষের মৃত্যু, সম্পর্কের ভাঙ্গন, একাকীত্ব, বেকারত্ব প্রভৃতি কারণও সাময়িক ইনসমনিয়ার জন্য দায়ী হতে পারে।
অন্যদিকে দীর্ঘদিনের বা ক্রনিক ইনসমনিয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে লক্ষ্য করা যায় তারমধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বা মানসিক অবস্থার দীর্ঘদিনের প্রতিকূলতা সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে করা হয়। যেমন দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক চাপে থাকলে বা বহুদিনের বিষন্নতা, একাকীত্ব উদ্বিগ্নতা ক্রনিক ইনসমনিয়ার কারণ হতে পারে। তাছাড়া মানসিক রোগ যেমন স্রিজফ্রেনিয়া, মোড ডিসঅর্ডার বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদিও এরজন্য দায়ী হতে পারে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিও ক্রনিক ইনসমনিয়ার রোগী হতে পারে।
পাশাপাশি বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কখনো অনিদ্রার অবস্থাকে ক্রনিক ইনসমনিয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া শারীরিক অসুস্থতা যেমন দীর্ঘদিনের ক্রনিক ব্যথা, হৃদরোগ, আ্যজমা বা শ্বাসকষ্ট, আ্যসিডিটি ইত্যাদির কারণেও দীর্ঘধিনের ইনসমনিয়া হতে পারে। আর ব্রেইন টিউমার বা স্ট্রোকের রোগীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই বেশিমাত্রায় দেখা যায়।
ইনসমনিয়ার উপসর্গ হিসেবে ঘুম না আসা, ঘুমালে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং আর ঘুম না আসা, খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং ঘুম পুরো না হওয়া, ঘুম থেকে ওঠার পর ক্লান্তিবোধ, দিনভর ঝিমুনি আসা কিন্তু ঘুম না হওয়া, বিরক্তিবোধের মাত্রা বাড়া, যেকোনো বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠা বা বিষন্নবোধ করা, মনোযোগের অভাব বা মনে রাখতে না পারা, টেনশন করা, মাথা ব্যথা বা মাথা ধরা, সামিজিকতায় অস্বস্তি বা অনীহা দেখা দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায়।
যখনই আপনি এমন কোনো উপসর্গ নিজের মধ্যে লক্ষ্য করবেন তখনই একটু বাড়তি সচেতন হয়ে উঠুন। প্রথমেই অনিদ্রার কারণটি সনাক্ত করার চেষ্টা করুন। কারণটি তুচ্ছ ভাবুন এবং মানসিক শক্তি দিয়ে সমস্যাটির মোকাবেলায় সচেষ্ট হোন। কায়িক পরিশ্রম বাড়িয়ে দিন। অবশ্যই দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু ব্যায়াম করুন। ঘুমের সময়ের আগেই নিজেকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত করার চেষ্টা চালান, যেন ঘুম আসে। কখনোই ঘুমের ওষুধের প্রতি নির্ভরশীল হবেন না। আপনি যে বিষয়গুলো করতে পছন্দ করেন তা প্রাধান্য দিন। যেমন গান শুনতে ভালো লাগলে হাল্কা ভলিউমে গান ছেড়ে রাখুন বা বই পড়তে ভালো লাগলে বই নিয়ে বিছানায় যান। কখনোই ঘুম আসছে না কেন এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন এনে রাতকে অর্থবহ করে তুলুন। সাময়িক ইনসমনিয়ার সবচেয়ে বড় ওষুধ মেডিটেশন। মেডিটেশন শিখে নিন এবং দেহ মনকে প্রফুল্লতার সাথে শান্ত নিয়ন্ত্রিত রাখুন। তবে ইনসমনিয়া যদি ক্রনিক আকার ধারণ করে তবে অবশ্যই চিকিৎকের পরামর্শ নিন। কখনোই ওষুধের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে বরং আত্মোন্নয়নের প্রতি যত্নশীল হয়ে এ সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালান।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/পিআর