ঘুসের মূল্যস্ফীতি!
মানুষের সেবা করা মহৎ কাজ। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। মানে তারা স্বেচ্ছাশ্রমে মানুষের সেবা করেন। তারা সত্যিকারের মহৎ মানুষ। এই মহৎপ্রাণ মানুষগুলো আছে বলেই পৃথিবী এখনও বাসযোগ্য। কিন্তু এমন মহৎ মানুষের সংখ্যা এখন কমে আসছে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো লোকদের সবাই বোকা ভাবে। এই বোকা মানুষগুলো মানুষের সেবা করে যে আনন্দ পান, তা চালাক লোকেরা কখনো বুঝতেই পারবেন না। বোকা লোকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। তারা মনের আনন্দে তাদের কাজ করতে থাকুক। সেবা তো আমাদের সবারই লাগে।
মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ দলবদ্ধভাবে থাকে। একজনের সাহায্যে আরেকজন টিকে থাকে। প্রয়োজনে মানুষ টাকা দিয়ে সেবা কিনতে তৈরি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হলো, কিছু ‘বোকা লোক’ বাংলাদেশে সেবা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। সেবাখাত মানেই যেন ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায়।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ চাপ্টার-টিআইবি একটি জরিপ করেছে। তার মোদ্দা কথা হলো- সেবা পেতে বেশি ঘুস দিতে হচ্ছে এখন। সেবা খাতে ঘুস আগেও ছিল, এখন আরেকটু বেড়েছে। অনিয়ম আর ঘুসে সেবা খাতে যেন প্রতিযোগিতা, কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, স্বাস্থ্যখাত, ভূমি সেবা- সবখানেই নৈরাজ্যের চূড়ান্ত।
সেবাখাত মানেই যেন হয়রানি আর ভোগান্তির এক অনন্ত উৎস। ইদানীং জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র আর পাসপোর্টের তথ্য অভিন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হযেছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। একজন মানুষের সব তথ্য অভিন্ন হওয়াই উচিত। কিন্তু এই তিনটার তথ্য মেলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন জেরবার। ছোটখাটো ভুল, নামের বানান, ঠিকানায় একটু এদিক-সেদিক হলেই তিন জায়গায় দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার জীবন বরবাদ হয়ে যাবে।
কখনো কখনো মানুষ লিখতে গিয়ে বা টাইপ করতে গিয়ে বেখেয়ালে ভুল করে ফেলতে পারে। তবে অধিকাংশ সময় ভুল হয় সরকারি কর্তাদের খামখেয়ালিতে। আর সেটা ঠিক করতে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে ঘুরতে হয়। আগেই বলেছি, সব জায়গায় একজন মানুষের সব তথ্য অভিন্ন হওয়াই উচিত।
এক্ষেত্রে কিছু হয়রানি হলেও তা মিলিয়ে নেওয়া ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো, সেবাদানকারী মানুষের মনোভাব। আপনি যদি মানুষকে সাহায্য করতে চান, তাহলে সহজেই তার ভুলটি ধরিয়ে দিয়ে সেটা শুধরে দিতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের এই সেবাখাতগুলো যেন একেকটা ফাঁদ। মানুষ ভুলটা নিজেরা করুক আর কর্তাদের দোষে হোক, একবার ভুল পেলেই যেন ফাঁদে আটকে ফেলা গেলো।
মুহূর্তেই যেটা সমাধান করে ফেলা যায়, তার জন্য দেখিয়ে দেবে আমলাতন্ত্রের সাতঘাট। এক মিনিটের কাজ করতে আপনার লেগে যাবে বছর। জন্মনিবন্ধন বা এনআইডি বা পাসপোর্ট নিয়ে দুর্ভোগের শিকার হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। পাসপোর্ট অফিস তো আমার কাছে এক গোলকধাঁধার নাম। এই রুম তো ওই রুম, এই লাইন তো ওই লাইন- চলতেই থাকবে।
পাসপোর্ট অফিসেরই এক মজার গল্প আছে আমার। এক ভাগিনার পাসপোর্ট করার জন্য তাকে নিয়ে গেলাম পাসপোর্ট অফিসে। বেশ আগের কথা, ভুলেও গেছি। কী একটা ছোট ভুলের কারণে আটকে গেছে পুরো প্রক্রিয়া। কুল কিনারা না পেয়ে এক কর্মকর্তার রুমে গেলাম। তিনি বিশাল এক বক্তৃতা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, এটা জটিল সমস্যা, সহজে সমাধান হবে না।
এটাও বলে দিলেন, এ ধরনের সমস্যায় বিরক্ত করে যেন তাদের জরুরি কাজের ব্যাঘাত না ঘটাই। তার রুম থেকে বেরিয়ে নিরুপায় হয়ে একজনের সহায়তা চাইলাম। তিনি একজনের নাম্বার দিলেন। ফোন করে রেফারেন্সে কথা বলতেই, আমন্ত্রণ জানালেন তার রুমে। রুমে গিয়ে আমিই লজ্জা পেলাম। একটু আগে যিনি আমাকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট দেখালেন; তিনিই এখন চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
সমস্যার মহাসাগর শুকিয়ে গেলো পাঁচ মিনিটেই। আমাকে আর কোথাও যেতে হয়নি। তার রুমে বসে চা খেতে খেতেই মিটে গেলো সব ঝামেলা। ভাগ্যিস প্রথমবার ঝাড়ি দেওয়ার সময় তিনি চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকাননি। তাহলে তাকে অল্প হলেও লজ্জা পেতে হতো। আমাকে পেতে হতো তারচেয়ে বেশি। চিনে ফেলতে পারেন, এমন আশঙ্কা থাকলে, আমি অবশ্য দ্বিতীয়বার তার রুমে যেতামই না। এই যে একজন সেবাদাতা সেবাগ্রহীতার মুখের দিকেই তাকান না, যে সমস্যা পাঁচ মিনিটেই মিটে যেতে পারে, সেটার জন্য হাইকোর্ট দেখিয়ে দেন; এটা কেন আমার মাথায় ঢোকে না।
মানুষকে ভুগিয়ে তারা কী আনন্দ পান জানি না। এই সমস্যাটা আমার বারবার হয়। কোথাও গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়ে কিছু লিখলে, অনেকেই ফোন করে বলেন, আরে আপনি আসবেন আগে বলবে না বা আমাকে বললেই হতো বা আপনার পরিচয় দেননি কেন? আমি তাদের বিনয়ের সাথে বলি, আমি তো বৈধ সেবা যথাযথ মূল্য দিয়ে পেতে চাইছি। সেটা পেতে আমাকে পরিচয় দিতে হবে কেন বা কাউকে আলাদা করে বলতে হবে কেন।
বুঝি আমাদের দেশে মানুষ বেশি, তাই একটু সময় তো লাগবেই। কিন্তু যখন বুঝি, কর্মকর্তারা আন্তরিক হলে আরও অনেক কম ভোগান্তিতেই কাজটি করে ফেলা যেতো, তখন মন খারাপ হয়ে যায়। আমি সবকিছু সরলভাবে দেখি। লাইন ভেঙে কিছু করতে বা কানে কানে কিছু বলতে আমার লজ্জা লাগে। আমি জানি, ঘুস ছাড়া বাংলাদেশে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। কিন্তু কাউকে ঘুস আমি দিতে পারি না। মনে হয়, তাকে অপমান করা হয়।
সাংবাদিক পরিচয় কখনো কখনো হিতে বিপরীত হয়। আমি যেমন ঘুস সাধতে লজ্জা পাই। আবার তারাও ঘুস চাইতে পারেন না। ফলে কাজটা আর হতে চায় না। ইদানীং অনলাইনেই পাসপোর্টের সব ফরম পূরণ করা যায়। ছবি তোলার তারিখও অনলাইনেই দেওয়া হয়। সাধারণত সেই তারিখ পেতে অনেক লম্বা সময় লাগে। আমি ভেবেছি, এটাই নিয়ম। অনলাইনে তো আর ব্যতিক্রমের সুযোগ নেই। আমার কথা শুনে বন্ধুরা হাসেন আর বলেন, দালাল ধরলে আগেই তারিখ পাওয়া যায়। সেটা কীভাবে সম্ভব, আমার মাথায় ঢোকে না।
পাসপোর্ট অফিসের চেয়েও বেশি ভয় পাই আমি বিআরটিএকে। গাড়ির কাগজপত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয়, তা নিয়ে সবাই মহাকাব্য লিখতে পারবেন। আমার তো বিআরটিএ’র সামনে গেলেই ভয় লাগে। পুলিশ মানুষের বন্ধু হওয়ার কথা। কিন্তু মানুষ পুলিশকে দেখলে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। রাস্তাঘাটে নিরীহ মানুষের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা তো অহরহ ঘটে। জিডি করতেও নাকি টাকা লাগে।
হাসপাতাল হলো মানুষের হয়রানির আরেক উর্বর ক্ষেত্র। মানুষের অসুস্থতাকে পুঁজি করে তারা ব্যবসা করে। সরকারি হাসপাতালে তো ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই দশা। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ পেতে নাকি মন্ত্রীর সুপারিশ লাগে। বেসরকারি হাসপাতালে যাবেন? পকেট কাটবে, কিন্তু সেবা পাবেন না। সরকারি হাসপাতালেরটা বাদই দেন।
বেসরকারি হাসপাতালে তো আপনি পয়সা দিয়ে সেবা কিনতে যাবেন। যত পয়সা, তত সেবা। কিন্তু বাস্তবে পয়সা নেবে ফাইভ স্টার মানের, সেবা দেবে সরকারি হাসপাতালের মতো। আপনার কী হয়েছে, সেটা ডাক্তার আপনাকে বলবেন না। গম্ভীর হয়ে থাকাটাই বাংলাদেশে ডাক্তার হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। রোগীদের সাথে হাসি মুখে কথা বললে যেন তাদের মান কমে যাবে।
গাদা গাদা টেস্ট দেবে, কেন করতে হবে তার কোনো ব্যাখ্যা আপনি পাবেন না। বিল কেন আকাশ ছুয়েঁছে, কেউ আপনাকে জবাব দেবে না, বুঝিয়ে দেবে না। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই। কার কাছে প্রতিকার চাইবেন। যেখানে প্রতিকার চাইতে যাবেন, সেখানেও যে আপনাকে হয়রানির শিকার হতে হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার ভোগান্তির অভিজ্ঞতা কম। আমি যেহেতু ঢাকায় উদ্বাস্তু, মানে চির ভাড়াটে। তাই আমাকে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের অফিসে যেতে হয় না। ভূমি অফিসেও আমার কোনো কাজ নেই। সচিবালয়েও যাওয়ার দরকার হয় না। জীবনে কখনো কোনো কাজে থানায় যেতে হয়নি, আদালতে যেতে হয়নি। শিক্ষা অফিসে যেতে হয়নি। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ভোগান্তির গল্প শুনতে শুনতে মন খারাপ হয়ে যায়, ক্লান্ত লাগে।
থানা ভয়ঙ্কর, আদালত নাকি ভয়ঙ্করতম। থানায় ভোগান্তি তো অল্প সময়ের, আদালতের ভোগান্তি বছরের পর বছর। যারা আমাদের সন্তানদের নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন, সেই শিক্ষকরা শিক্ষা ভবনে এসে নিজেরা নৈতিকতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হন।
ঘুস ছাড়া এখানে কোনো কাজ হয় না। ঢাকায় ঘুস দিয়ে কাজ করে, সেই শিক্ষক গ্রামে ফিরে কোন মুখে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শেখাবেন? সেবা খাতে হয়রানির হাজারটা, লাখোটা, কোটিটা উদাহরণ দিতে পারবেন সাধারণ মানুষ। টিআইবির অনেক রিপোর্ট বা জরিপের সাথে কখনো কখনো ভিন্নমত থাকে। তবে সেবাখাতে দুর্নীতির রিপোর্ট নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই।
বরং আরও বেশি মানুষকে জরিপের আওতায় আনতে পারলে আরও ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যেতে পারতো। আগের চেয়ে বেশি ঘুস দিতে হচ্ছে, এটাতেও আমি অবাক হইনি। সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি যেভাবে আমাদের গলায় ফাঁস হয়ে যাচ্ছে; ঘুসের রেট না বাড়ালে ঘুসখোরেরা চলবেন কীভাবে? সবকিছুর মতো বাংলাদেশে ঘুসেরও মূল্যস্ফীতি ঘটেছে।
১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস