রম্য
মরহুমনামা
লতিফা মজিলের মোসাম্মৎ লতিফা বেগম অকস্মাৎ একদিন আমাকে মৃত ঘোষণা করে বসল...
রবীন্দ্রনাথের সুরবালা জুটির মতো একসাথে আমরা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো পাঠশালায় যাইনি সত্য; কিন্তু প্রকৃতির পাঠশালায় আমাদের যুগল মূর্তির উপস্থিতি ছিল ভয়ানকভাবে সরব। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষতলে উপবেশন করে সবুজ অন্ধকারের স্বরূপ অন্বেষণে আমরা দিনের পর দিন অক্লান্ত গবেষণা চালিয়েছি।
বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও সংসদ ভবনের সবুজ চত্বরের ঘাসের ডগা দিয়ে নাকফুল বানানোর মতো জটিল প্রযুক্তির রুদ্ধ বাতায়ন উন্মোচন করার গৌরব অর্জন করেছি আমি; আর সেই গৌরবে গরবিনী হয়ে ঘাস-নির্মিত নাকফুলে সজ্জিত বর্ণময় নাসিকা ঈষৎ স্ফীত করে আবেগ আকুল কণ্ঠে লতিফা বেগম বলেছে- হবে মফিজ, তোমার হবে।
রমনা পার্কের কদমতলায় বসে আমি নিজে যদিও বাঁশি বাজাইনি; তবে ইউটিউব থেকে বাঁশির সুর শুনিয়েছি ওকে। সেই সুরের পরশে বেণীবন্ধ লতিফা বেগম এলোকেশিতে রূপান্তরিত হয়ে গেয়ে উঠেছে-বংশী বাজায় কে রে সখী, বংশী বাজায় কে! বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়েছি আমরা প্রজাপতির ছন্দময় পাখা দোলানো দেখতে।
রাজেন্দ্রপুরের অরণ্যে গিয়েছি ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে। খঞ্জরদিয়ায় গিয়েছি পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে। এসব করতে গিয়ে অর্থাৎ প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হওয়ার আকুলতায় আমি আমার টিউশনি-লব্ধ অর্থ ছাড়াও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেছি, বাবার পকেট সাফাই করেছি, বড় ভাইয়ের কাছে হাত পেতেছি, এমন কি ভাবির বাজারের টাকায় সুকৌশলে ভাগ বসিয়েছি।
শিক্ষার মতো মৌলিক একটা বিষয়ে টাকা খরচ করতে আমার বিন্দুমাত্র কার্পণ্য তো ছিলই না, উপরন্তু প্রয়োজনে আমি আমার জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম। অথচ কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি! অনুগত ছাত্র হিসেবে আমি যে আমার জীবনকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করি, তা প্রমাণ করার সুযোগ না দিয়েই লতিফা বেগম তার জীবন-সংসদের কার্যপ্রণালি থেকে আমাকে এক্সপাঞ্জ অর্থাৎ মৃত ঘোষণা করে দিল।
‘মজিফ-কট’ হওয়ার পর যতবার লতিফা বেগমের নম্বরে ফোন করেছি, ততবারই উত্তর এসেছে- নেই। আগে ব্যালেন্স স্বল্পতার জন্য বা অন্য কোনো কারণে একদিন ফোন করলেই লতিফা বেগম হাহাকার করে উঠতো- হায় মফিজ! আমার পৃথিবী থমকে ছিল গতকাল।
লতিফা বেগমের ‘পৃথিবী’ এখন কী অবস্থায় আছে, তা জানার বাসনা আমাকে পেয়ে বসে এবং এজন্য শেষ পর্যন্ত আমি ইলিয়াস নামে আমার এক বন্ধুর শরণাপন্ন হই; ইতোমধ্যে যে শখের থিয়েটারে সখি সেজে প্রচুর হাততালি পেয়েছে। বান্ধবীরূপী ইলিয়াসের ফাঁদে লতিফা বেগম পা দিতেই ফোনের দখল নিয়ে বলি-
: হ্যালো, লতিফা!
: ও, তুমি!
: হ্যাঁ লতি, আমি!
: আরে কান্নার কী হলো? কাঁদছ কেন!
: আর কেউ কাঁদে না বলে!
: মানে?
: মানে হলো, যখন কেউ মারা যায়, তখন তার নিকটজনরা কান্নাকাটি করে। আমার বেলায় এমনটি ঘটেনি তো, তাই নিজের কান্না নিজেই কাঁদছি।
: ইন্টারেস্টিং! কিন্তু তুমি মারা গেলে কবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
: বুঝতে পারছো না; নাকি না বোঝার ভান করছো? কেন, গত মাসের সতের তারিখে হাজি কোরবান আলীর আমেরিকাফেরত ছেলে ইরফান আলীর সঙ্গে যখন তুমি চাইনিজ খেতে...
: এটাকে তুমি মরে যাওয়া বলছো?
: এরপরও আমি বেঁচে আছি বলতে চাও?
: মফিজ, আমাকে রাখতে হচ্ছে। ঘরে একগাদা মেহমান।
: প্লিজ লতু; ফোন রেখো না।
: কী যন্ত্রণা!
: এ কথা তুমি বলতে পারলে লতি? আমি তোমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন...
: স্বপ্ন! প্রতিদিনই দেখ নাকি?
: আলবৎ দেখি। দিনের স্বপ্ন তো আছেই; রাতেও স্বপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে। এই তো গত রাতেই দেখলাম।
: কী দেখলে!
: দেখলাম, তুমি আর আমি দুজন দুজনের হাত ধরে আকাশ ভ্রমণে বের হয়েছি।
: বলো কী! কিসে করে?
: কোনো কিছুতে করে না।
: তবে?
: পাখায় করে।
: পাখা?
: হ্যাঁ পাখা। স্বপ্নে দেখি, তোমার পিঠে দুটো পাখা গজিয়েছে আর আমার পিঠেও দুটো পাখা গজিয়েছে।
: দারুণ তো! তারপর?
: পরেরটা আরও দারুণ। উড়তে উড়তে আমরা যখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ আমার একটি পাখা ভেঙে সাগরের পানিতে পড়ে গেলো। একটু পরে অন্যটিও।
: সর্বনাশ! তুমি নিশ্চয়ই অতল সমুদ্রে...
: আরে না। তেমন কিছু হয়নি। তুমি ছিলে না পাশে? তুমি এসে আমাকে ধরে প্রথমে বললে, আমার একটি পাখা তুমি নাও মফিজ। পরে বললে, কিন্তু এক পাখা দিয়ে তো উড়া যাবে না; তার চেয়ে এসো আমরা দুজন এক সত্তায় লীন হয়ে যাই আর আমাদের দুজনের উড়বার মাধ্যম হোক অবশিষ্ট এই দুটি পাখা।
: তোমার স্বপ্নে দেখছি বাস্তবতার ছোঁয়া আছে প্রচুর!
: সত্যি?
: হ্যাঁ। আগামী মাসের ২৬ তারিখ রাতে আকাশে উড়ব আমি।
: ঠাট্টা করছো?
: মোটেই না। আমেরিকা চলে যাচ্ছি আমি।
: ক-ক, কা-র সাথে?
: হাজী কোরবান আলীর একমাত্র ছেলে ইরফান আলীর সাথে...
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জিকেএস