পুলিশের বিরুদ্ধে যৌন অযৌন হয়রানির অভিযোগ এবং মিডিয়ার মূর্খতা


প্রকাশিত: ১০:২৮ এএম, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কাল সকালে আমার বিরুদ্ধে যদি শ্লীলতাহানির, যৌন হয়রানির  কোনো অমূলক অভিযোগ ওঠে, তাতে মোটেও বিস্মিত হবো না আমি। কেননা, বিস্মিত হতে যে সময়টুকু লাগে, তারচেয়েও অধিক কম সময়ে অভিযুক্তকে হয়রানি করা সহজ এক্ষেত্রে। অভিযোগ করলেই হলো। সত্যাসত্য প্রমাণ, সেতো অনেক সময় বাকি। ততক্ষণে অভিযুক্তের ১২টা, ২৪টা, ৩৬টা, ৪৮টা- যা বাজার তারচেয়েও অনেক বেশি বেজে যায়। প্রচলিত আইনের ধারা, উপধারার ফাঁকফোকরের কারণে, কে কোথায় কিভাবে সুবিধে নিচ্ছে, অসুবিধেয় পড়ছে কে, ভুগছে কে ভোগাচ্ছে কাকে, কে রাখে সে খবর! আর নারী হলে তো কথাই নেই। আমি নির্যাতিত, আমি ভিক্টিম, আমি শ্লীলতাহানির, যৌন হয়রানির শিকার এমনটি বলতেই যা সময় লাগে, ভোগাতে সময় লাগে তারচেয়ে আরও অনেক কম।

যৌন অভিযোগ দুর্দান্ত এক অস্ত্র। নারীর জন্য, পুরুষের জন্যও। যে কোনো মারণাস্ত্রের চেয়েও তা কম ভয়ঙ্কর নয়, কোনো অংশে। যে কোনো মেয়েকে দুঃশ্চরিত্র বলার চেয়ে সহজ কাজ জগতে দ্বিতীয়টি নেই। পুরুষের ক্ষেত্রেও তাই। যে কোনো পুরুষকে লম্পট, দুঃশ্চরিত্র বলে ফেললেই হলো, আর শ্লীলতাহানি বা যৌন হয়রানির চেষ্টার অভিযোগ সেতো আরও ভয়ঙ্কর। এতে শ্লীলতাহানি বা যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটাতে হয় না। কেননা ঘটেনি বা ঘটবার আগপর্যন্ত তো ‘সবটাই চেষ্টা’ বলে চালিয়ে দেওয়া সহজ। চেষ্টা বড়ই বায়বীয় একটি শব্দ। আর আইনি ভাষায় ‘এমন চেষ্টা’ আরও ভয়াবহ। যৌন অভিযোগের এ হাতিয়ার নতুন নয়, পুরনো। এর কোনো পূর্ব-পশ্চিম নেই। ধর্ম-অধর্ম নেই। রাজনীতি-অরাজনীতি নেই। জাতপাত নেই- করলেই হলো। ইতালির বারলুসকুনি, আইএমএফের প্রেসিডেন্ট ট্রসকান থেকে শুরু করে কে নয়, যৌন হয়রানির অভিযোগের শিকার?

২.
আমাদের একটি দার্শনিক দারিদ্র্য আছে। কোনো ঘটনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চাই না আমরা। আতশকাঁচের তলে ফেলি না। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, যা শোনা যায়, যা বলা হয়, তাই বুঝতে চাই- এর বাইরে কিছু নয়। এটিই আমাদের দর্শনগত ত্রুটি ও দুর্বলতা। আমাদের মিডিয়ার অবস্থাও তথৈবচ। বাণিজ্যিক মিডিয়া শ্রোতের অনুকূলেই সাঁতার কাটে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তো বিলুপ্তপ্রায়। বরং কি জাতীয় শব্দে, সংবাদ পরিবেশনে দ্রুত পাঠক, দর্শক ধরা যাবে, অনলাইনে হিট বাড়বে, তাতেই ব্যস্ত সবাই। কখনও কখনও সাংবাদিকতার ন্যূনতম নৈতিকতার সীমাটিও মানতে চাই না।

গত কদিন আগে পুলিশের এসআই রতন হালদারের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির খবরটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। প্রথমে দুএকটি, পড়ে বেশ কয়েকটি খবরের কাগজ, অনলাইন পড়ে আমার মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যুবদল নেতা সজীব আহমেদ রানার স্ত্রী ফারহানার বর্ণনায় ঘটনাটি ঘটেছে আদাবর থানা এলাকায়। অথচ তিনি অভিযোগ করতে গিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানায়। থানার পুলিশ তার মামলাটি নিতে চাননি বলে অভিযোগ করেছেন। আদালতে গিয়ে মামলা করেছেন। কিন্তু থানায় ডিউটিরত প্রত্যেক পুলিশের নাম-পরিচয় জানা যায়, অথচ মামলাটি কোন পুলিশ নিতে চায়নি তা তিনি কেন জানাননি? তিনি তো চ্যালেঞ্জ করতে পারতেন, কেননা ঢাকার প্রতিটি থানা এখন সিসি টিভির আওতাভুক্ত। সিসি টিভির ফুটেজেই তো অস্বীকৃতি জানানো পুলিশকে শনাক্ত করা যেতো। ফারহানা জানিয়েছেন, তাকে রাস্তায় গতিরোধ করে এসআই রতন এবং দুই পুলিশ সদস্য। ইয়াবা আছে এই সন্দেহের কথা বলে পাশের একটি দোকানে নিয়ে যায়। অথচ যমুনাসহ আরও কয়েকটি টেলিভিশনের খবরে দেখেছি প্রত্যক্ষদর্শী দোকানিরা তা অস্বীকার করেছেন।

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগের আচরণটি রীতিমতো বিস্মিত করার মতো। ঘটনার সত্যতা বা অভিযোগ প্রমাণের অনেক আগেই রতন হালদারকে বরখাস্ত করেন তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার। জানা যায়, বিস্ফোরক আইনে চার্জশিট দেওয়া মামলার আসামির স্ত্রীকে রাস্তায় আটকে কথা বলতে কেন গেলেন এমন যুক্তিতেই তিনি বরখাস্ত করেছেন রতন হালদারকে। অভিযুক্ত রতনের যুক্তি, তিনি পলাতক আসামি যুবদলের সন্ত্রাসী রানা, যিনি ইয়াবা রানা হিসেবেও পরিচিত, তার হদিস জানতে চেয়েছেন তার স্ত্রী ফারহানার কাছে। পাশাপাশি ফারহানা নিজেও ইয়াবা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, সোর্স মারফত এমন তথ্য পেয়েই ফারহানার গতিরোধ করেন তিনি। থানায় যেতে বলেন, কিন্তু কোনো নারী পুলিশ সদস্য না থাকায় ফারহানাকে আর থানায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফারহানা এসআই রতন হালদারকে ‘দেখে নেব কিভাবে চাকরি করিস’ বলে শাসান। রতন হালদার তা তার ঊর্ধ্বতনকে জানান এবং থানায় এসে হুমকির জিডি করেন।

৩.
একজন ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার অভিযোগ প্রমাণের আগেই শাস্তি দিয়েছেন রতন হালদারকে। অপরাধ প্রমাণের আগেই অপরাধী বানিয়ে দিয়েছেন তাকে। কোনো কোনো মিডিয়ার আচরণও তাই। প্রায় বেশির ভাগ অর্ধ শিক্ষিত মিডিয়ার ‘এবার এসআইএর যৌন হয়রানি’, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে পুলিশের শ্লীলতাহানী’, ‘এসআই রতন শ্লীলতাহানী করলেন এক ছাত্রীর’ এমন সব শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ‘অভিযুক্ত’ শব্দটি ব্যবহারের প্রয়োজনও মনে করেনি এসব অর্ধশিক্ষিত প্রতিবেদকেরা। নাকি শ্লীলতাহানীর, যৌন হয়রানির একটি দৃশ্যকল্প ভেবে পুলক পেতে ও পাঠকদের পুলকিত করতে চেয়েছিলেন তারা, সেটিও বিবেচ্য।

আবার অনেকেই লিখেছেন ‘ভুক্তভোগী’ ফারহানা আক্তার। ফারহানা অভিযোগকারী, অভিযোগ প্রমাণের আগে তিনি ভুক্তভোগী কি অভুক্তভোগী সেই সিদ্ধান্ত কী করে নেই আমরা। কখনও কখনও মিডিয়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের আগেই তাকে শাস্তির মঞ্চে দাঁড় করায়। অশিক্ষা, অর্ধশিক্ষা, ‘বিশেষ শিক্ষা’র কারণে এমনটি মিডিয়াতে হরহামেশাই ঘটে থাকে। এমন ঘটনা এর আগেও দেখা গেছে।

আমি বলছি না, অভিযুক্তদের কেউ স্বর্গ থেকে আসা আশ্চর্য দেবদূত। মানুষের পক্ষে তা হওয়া সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। কিন্তু যে অভিযোগগুলো ঢালাওভাবে, একতরফাভাবে করা হয়েছে, এখানে কোথায় যেন যুক্তির ফাঁক, কোথায় যেন মিথ্যের প্রলেপ আছে মনে হয়।
মানবিক বিশ্বে কেউ-ই যেন হয়রানির শিকার না হয়, দুর্ভোগ না পোহায়, যৌন অযৌন কোনো মিথ্যে অস্ত্রের শিকার কেউ হোক চাই না। সততার সঙ্গে, শ্রম ও মেধার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে এসে, হয়রানির বিরুদ্ধে লড়তে এসে কেউ যেন নিজেই হয়রানির শিকার না হয়, হলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই নেই।

লেখক: উপ-সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ, পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর, ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন, সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম যুক্তরাষ্ট্র

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।