শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ

ড. মতিউর রহমান
ড. মতিউর রহমান ড. মতিউর রহমান , গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২২

আগস্ট মাস শোকের মাস। আগস্টজুড়ে বাঙালি জাতি স্মরণ করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীনতার স্থপতি এই মহান নেতাকে বীর বাঙালি তাদের হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা জানাবে। ঘৃণা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করবে সেইসব বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের প্রতি, যারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

আগস্ট মাস বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখের মাস। এ মাসেই জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক এবং কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ মাটির সোনার সন্তান, এ দেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন সোনার বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছিল এই মহান বীরের তাজা রক্তে।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন তার প্রিয় বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলে, তার প্রিয় গরিব, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। স্বাধীনতার পর তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অকৃতজ্ঞ নর ঘাতকদের নির্মম বুলেট তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ স্তব্ধ করে দেয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে তার প্রিয় পরিবারের সদস্যসহ হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনাও একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের শিকার হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দ্বারা হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে আরেকটি কলঙ্কিত ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়।

 

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ছিন্নভিন্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তারা পারেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গরিব, দুঃখী, অসহায় মানুষের কাছে সেইসব কুচক্রী পরাজিত হয়।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া ও নানা ষড়যন্ত্রের জাল ভেঙে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা এবং পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর বাকি ছয় পলাতক খুনির ফাঁসির অপেক্ষায় এখনো পুরো জাতি।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। এই শোক আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম জার্মানির নেতা ও নোবেল বিজয়ী উইলি ব্রান্ডট বলেছেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’

বিশিষ্ট লেখক নীরদ সি. চৌধুরী বাঙালিদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যা করে বাঙালিরা তাদের আত্মঘাতী চরিত্র বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ উল্লেখ করেছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টে যায়। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর দখল করে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ক্ষমতার উত্থান ঘটে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি হ্রাস পায়, যা একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে ন্যায়-অন্যায় কোনো ভেদাভেদ ছিল না। ১৫ বছর ধরে সামরিক শাসন চলে। স্থগিত করা হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। সাধারণ মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার হারায়। ভোট ও ভাত দেওয়ার অধিকার সেনা ক্যাম্পে বন্দি হয়। দেশে অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা বিরাজমান থাকে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি খুনিরা। তারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও বিকৃত করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করা হয়েছে, ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করা যায়নি এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে জিয়াউর রহমানের নাম প্রচার করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা হয়। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুতর অপরাধ যেমন খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করেছিল তাদের ক্ষমা করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি ছিল।

১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হয় এবং সব যুদ্ধাপরাধী রাতারাতি মুক্তি পায়। দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। রাজাকাররা বুক ফুলিয়ে সমাজে হেঁটে বেড়ায় আর মুক্তিযোদ্ধারা মাথা নিচু করে ভিক্ষা করে। শহীদ পরিবারের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বেড়ে যায় বহুগুণ। মানবতা লঙ্ঘনকারীদের অন্যায় করার জন্য আরও উৎসাহ দেয়।

জাতির ইতিহাসে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে এই আগস্ট মাসে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারীরা আবারও তার কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান।

আগস্ট মাস এলে বাঙালি কাঁদে। স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা তাদের পিতা হারানোর বেদনা বহন করে মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করে।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রায় কার্যকর করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনরা। একইভাবে বাঙালির আত্মঘাতী চরিত্রের অপবাদেরও অবসান ঘটে।

দ্য টাইমস অব লন্ডন তার ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সংখ্যায় উল্লেখ করে, ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তিনি ছাড়া বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব নেই।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইস্পাত-কঠোর নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে তার অধিকার আদায়ের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা। জাতির পিতার দূরদর্শী, সাহসী ও জাদুকরী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদয় ছিনিয়ে এনেছিল। বাঙালি পেয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত।

সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন গোটা জাতিকে নিয়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার সংগ্রামে মগ্ন, তখন স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী চক্রের হাতে নিহত হন। এর মাধ্যমে তারা বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অগ্রগতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করা এবং আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নষ্ট করা।

১৫ আগস্ট একজন রাষ্ট্রনায়ককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয় ঐক্য, প্রেরণা ও স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক, বাঙালি জাতির স্বপ্নের মূর্ত প্রতীক।

তাই আমাদের দায়িত্ব হবে জ্ঞান ও মর্যাদায় সমৃদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে অসম্পূর্ণ কাজগুলো পূরণ করে বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। তবেই আমরা এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব। সেই সঙ্গে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে আমরা এগিয়ে যেতে সক্ষম হবো।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

দ্য টাইমস অব লন্ডন তার ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সংখ্যায় উল্লেখ করে, ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তিনি ছাড়া বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব নেই।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইস্পাত-কঠোর নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে তার অধিকার আদায়ের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।