সাধারণ মানুষ ভর্তুকি দেবে কোত্থেকে?
জ্বালানি তেল একটি অতি স্পর্শকাতর পণ্য। তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই চারদিকে হাহাকার পড়ে যায়। অবশ্য শুধু জ্বালানি তেল নয়, যৌক্তিক হোক অযৌক্তিক, যে কোনো পণ্যের দাম বাড়লেই আমরা শোরগোল তুলি। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ইস্যুটা অনেক বেশি জনসম্পৃক্ত, তাই এ নিয়ে হইচইও হয় বেশি। তবে এবারের প্রতিক্রিয়াটা নিছক হাহাকার নয়, চিৎকারে পরিণত হয়েছে। কারণ এবার দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ- ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত। এটা ঠিক জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তবে দাম বাড়ার এই হার অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় এবং নজিরবিহীন।
শুরুতেই যেমনটি বলছিলাম, জ্বালানি তেল একটি অতি স্পর্শকাতর পণ্য। জ্বালানি হলো দেশের গতি, প্রগতি, উন্নয়নের চাবিকাঠি। অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্য আছে, যেগুলোর দাম বাড়লেও তার প্রভাব হয় একমুখী। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব হয় বহুমুখী। যেমন- দেশে এখন স্বর্ণের দামেরও রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু তাতে দেশের কোটি কোটি মানুষের কিছুই যায় আসে না।
গরুর মাংসের দাম বাড়লেও না ভাবলেও চলে। এমনকি চালের দাম বাড়লেও মানুষ বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করতে পারে। নিত্যপণ্য ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও ব্যবহার কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। পাহাড়ের অনেক মানুষ আছেন, যারা তেল ছাড়াই রান্না করেন। তারচেয়ে বড় কথা হলো, চাল বা সয়াবিন তেলের দাম বাড়লে শুধু চাল বা সয়াবিন তেলের দামই বাড়ে। কিন্তু জ্বালানি তেল এমন এক পণ্য, যার দাম বাড়ার প্রভাব হয় সর্বগ্রাসী।
প্রথম ধাক্কাটা লাগে পরিবহন খাতে। বাসভাড়া, ট্রাকভাড়া, লঞ্চ- সব ধরনের পরিবহনের খরচই বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে সবক্ষেত্রে। দেশের প্রতিটি মানুষকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব স্পর্শ করে। একদম প্রান্তিক যে মানুষটি, তাকেও সন্ধ্যা বাতি দেওয়ার জন্য হলেও কেরোসিন কিনতে হয়। যদি আপনাকে কোনো ধরনের জ্বালানি তেল কিনতে নাও হয়, তাও জ্বালানি তেলের দামের উত্তাপ আপনাকে স্পর্শ করবে।
যে সবজি আপনি কিনবেন, সেটা আপনার বাজার পর্যন্ত আনবে যে পরিবহন, তাকে তো বাড়তি দামেই তেল কিনতে হবে। ফলে সেই সবজির দাম কিন্তু বেড়ে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে, শিল্পখাতে খরচ বাড়বে, কৃষি উৎপাদনে খরচ বাড়বে। জ্বালানি তেল হলো চক্রবৃদ্ধি হারের সুদের মতো, এর প্রভাবও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।
সুখের কথা হলো জ্বালানি তেলের দাম যতটা বেড়েছে, বাসভাড়া ততটা বাড়েনি। ১৬ থেকে ২২ শতাংশ বেড়েছে বাসভাড়া। শঙ্কাটা হলো, এই ভাড়া কার্যকর করা যাবে কি না তা নিয়ে। পরিবহন মালিকরা কখনোই সরকারের নির্ধারিত ভাড়া অনুসরণ করে না। অনেক ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে। শুরুতে কিছুদিন মোবাইল কোর্ট থাকে, যাত্রীদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের হট্টগোল বাধে। তারপর ঐক্যবদ্ধ পরিবহন শ্রমিকদের কাছে একসময় হার মানে সাধারণ মানুষ। বাসের ভাড়া তবু নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ট্রাক-লরির ভাড়ার স্বেচ্ছাচারিতা থামানো সত্যি কঠিন।
আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মূল্য সমন্বয়, বিপিসির লোকসান কমানো, পাশের দেশে পাচার বন্ধ- জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তিগুলো অকাট্য। কিন্তু সরকার তো ব্যবসায়ী নয় যে, তারা যে দামে কিনবে, সে দামে বা তারচেয়ে বেশি দামেই তাকে বিক্রি করতে হবে। জনকল্যাণ বিবেচনায় সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যে ভর্তুকি দেয়।
গত ছয় মাসে বিপিসি ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে, এটা যেমন সত্যি। আবার অতীতে, বিশেষ করে করোনার সময় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকলেও তখন মূল্য সমন্বয় না করে বিপিসি মোটা অঙ্কের লাভ করেছে। সে টাকায় সরকারও ভাগ বসিয়েছে, বিপিসিও তাদের নানা উন্নয়নকাজে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু আজ যখন মূল্য সমন্বয়ের বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো, তখন দায় পুরোটাই গেল সাধারণ মানুষের ঘাড়ে।
সরকার স্বীকার করছে না বটে, তবে অনেকেই বলছেন আইএমএফ’এর ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবেই জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানোর লক্ষণ দেখে এ কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। সরকার জ্বালানি তেলের ভর্তুকি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার দিকেই এগোচ্ছে মনে হয়। এর আগে ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়ে সারের ভর্তুকিও কমানো হয়েছে।
অনেকে বলছেন, কর কমিয়ে হলেও দাম আরেকটু কম বাড়ানো উচিত ছিল। আসল সমস্যা তো সেখানেই। সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, কর আদায় পর্যাপ্ত নয় বলে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন। কম কর আদায়ের দায় থেকেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই কর কমিয়ে দাম কম রাখার সুযোগ থাকলেও সরকারের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। পাচার বন্ধ- জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর একটি স্থায়ী যুক্তি। কিন্তু সীমান্তে কঠোর নজরদারির মাধ্যমেও এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল।
জ্বালানি তেল আসলে দুই ধরনের। পেট্রল আর অকটেনের বড় লোকের জ্বালানি। ডিজেল আর কেরোসিন গরিবের জ্বালানি। মোটরসাইকেলও পেট্রলে চলে বটে, তবে পেট্রল-অকটেন মূলত বড় লোকের দামি গাড়ির জ্বালানি। অনেকের ধারণা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে গাড়ির ব্যবহার কমবে। কিন্তু আমার ধারণা উল্টো। চারজনের পরিবারে যাদের চারটা গাড়ি তাদের আসলে তেলের দামে কিছু যায় আসে না।
তাই পেট্রল-অকটেনের দাম আরও বাড়িয়ে হলেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম নাগালে রাখার চেষ্টা করা উচিত। কেরোসিন তো একদমই প্রান্তিক মানুষের জ্বালানি। আর ডিজেল হলো, সব মানুষের জ্বালানি। পরিবহন, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন- সবকিছুর জন্য চাই ডিজেল। তাই ডিজেলের দামটা আরেকটু কম রাখতে পারলে দাম বাড়ার উত্তাপটা এমন অসহনীয় মনে হতো না।
অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতেই সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এর আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং শুরু করেছে। সাশ্রয়ের কথা অনেকদিন ধরেই বলা হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ, দক্ষমতা বাড়ানো, পাচার বন্ধ, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি ঠেকাতে পারলে এমনিতেই অনেক সাশ্রয় হবে। তখন আর চাপটা অত গায়ে লাগবে না। কিন্তু সরকার হাজার কোটি টাকার পাচার ঠেকাতে না পেরে, বিদ্যুতের আলোয় কোপ বসিয়েছে। কথায় বলে, সামনে দিয়ে মশা গেলেও আমরা লাফিয়ে উঠি, পেছন দিয়ে হাতি গেলেও টের পাই না।
কোনো বিকল্প সমাধানের পথে না গিয়ে উচ্চহারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার ভর্তুকির দায় মাথা থেকে ঝেরে ফেলেছে। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তে যে সাধারণ মানুষ বহুমুখী চাপে পড়বে, তা কীভাবে মোকাবিলা করবে তারা। করোনার পর থেকেই মানুষের আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই আকাশে উঠে আছে। মূল্যস্ফীতি চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। নতুন এই চাপ কীভাবে সামলাবে?
সরকার যেমন বাজেট দেয়, সাধারণ মানুষেরও তো পরিবারের বাজেট আছে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে নিজেদের চাপটা সাধারণ মানুষের ওপর ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই বাড়তি ব্যয়ের ভর্তুকি কোত্থেকে দেবে? জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। আয় তো বাড়ছেই না বরং করোনার পর অনেকে বেকার হয়েছে, অনেকের আয় কমেছে। নির্ধারিত আয়ের মানুষ বিলাসিতা ছেড়েছে অনেক আগেই। শিক্ষা-চিকিৎসা ব্যয়ও কমিয়েছে। দুধ-ডিম-মাংসের পুষ্টিতে টান পড়েছে। এবার বুঝি ভাতের থালায়ও টান পড়বে।
অল্প অল্প করে বাড়লে মানুষ চাপ সইতে শিখে যায়। বোঝার ওপর শাকের আঁটি দিলেও বয়ে নেয়া যায়। কিন্তু এবার তো শাকের আঁটির ওপর বিশাল বোঝা চাপানো হলো। সরকার নিজেদের ‘জনবান্ধব’ দাবি করে। এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে হলে এই বিপদে সংবেদনশীলতা নিয়ে তাদের পাশে থাকতে হবে।
৭ আগস্ট, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস