একটি তদন্ত কমিটির পোস্টমর্টেম
দবিরউদ্দিন উৎসাহ পাচ্ছেন না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠনের রেওয়াজ রয়েছে। এক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে। তিনি ভালো করেই জানেন, তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারণগুলো চিহ্নিত করে এজন্য যাদের শাস্তির সুপারিশ করবেন, তাদের একটা লোমও ঝরবে না।
দেশে প্রায়ই ঘটা লঞ্চ দুর্ঘটনা, অগ্নি দুর্ঘটনা, গ্যাস দুর্ঘটনা, রেল দুর্ঘটনাসহ অসংখ্য তদন্ত কমিটি গঠন যেমন পণ্ডশ্রম হয়, এটাও তেমনি স্রেফ একটা পণ্ডশ্রম হবে। পণ্ডশ্রম হলেও এর সঙ্গে চাকরির যোগসূত্র থাকায় কাজটা তাকে করতেই হবে। কাজেই দবিরউদ্দিন কাগজপত্রের ওপর চোখ রাখলেন।
কাগজপত্র বলছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০১১ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য প্রায় দুই টন ওজনের ক্রংকিটে তৈরি একটি বাঘ পান্থপথ মোড়ে স্থাপন করেছিল। এ সৌন্দর্যই শেষ পর্যন্ত একজন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। দবিরউদ্দিন এতদিন জানতেন, বনের বাঘ মানুষ খায়। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু বনের বাঘ নয়, সিটির বাঘও মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নেয়ার জন্য দবিরউদ্দিন কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তাকে ফোন করলেন। কর্মকর্তা অবাক হয়ে বললেন-
: আপনি এসব কী বলতেছেন স্যার! আমরা নগরবাসীর জীবন ও যাপন যাতে নিরবচ্ছিন্ন ও পরিপাটি থাকে, সেই মহৎ উদ্দেশ্য লইয়া রাইত-দিন পরিশ্রম করতেছি। আমরা কেন মানুষের মৃত্যুর কারণ হবো?
: বাঘটা আপনেরাই ওইখানে স্থাপন করছিলেন, এই কথা তো সত্য?
: স্যরি স্যার, আমরা কোনো বাঘ-টাঘ কোথাও স্থাপন করি নাই।
: কাগজপত্রে লেখা আছে...
: কী লেখা আছে?
: ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এই কাজ সম্পন্ন করছে।
: আপনে স্যার তাইলে দয়া কইরা অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে যান। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ফোন করছেন কেন? আপনে বিবাহ করার আগেই আমারে পোলার বাপ বানাইয়া দিবেন- এইটা তো ঠিক না। যে সময়ের ঘটনা, তখন আমরা কোনো দায়িত্বই পাই নাই। কাজেই এর কোনো দায়-দায়িত্ব আমাদের না।
দবিরউদ্দিন বিরস মুখে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলেন। একজন প্রকৌশলী হিসেবে তিনি যখন দেখলেন, বিরাট ওজনের এ বাঘটির নিচে লোহার রড দিয়ে শক্ত কোনো ভিত্তি তৈরি না করে শুধু ইট-বালু-সিমেন্টের একটা বক্সের ওপর স্থাপন করা হয়েছে, তার মাথা ঘুরতে লাগল। এখানে অনেক আগেই দুর্ঘটনা ঘটার কথা ছিল। প্রকৃতির অসীম দয়া যে, এতদিন তা ঘটেনি। দবিরউদ্দিনের মনে হলো, শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই নয়, প্রকৃতি বাংলাদেশের আরও অনেক কিছুর উপরই এরকম দয়া দেখিয়ে যাচ্ছে।
দবিরউদ্দিনকে প্রধান করে গঠিত এ তদন্ত কমিটিতে দু’জন সদস্য রয়েছেন। তাদের কথাবার্তা শুনে দবিরউদ্দিন পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, তাকে এক জোড়া গাধার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এরপর মানুষের একটাই করণীয় থাকে- মুখ হা করে ফুসফুসের সমুদয় হাওয়া বের করে দেয়া। দবিরউদ্দিন সেটা না করে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এখন আর হা-হুতাশ করে লাভ নেই; বরং গাধাসঙ্গ সহ্য করার মানসিক শক্তি অর্জন করা দরকার।
জোড়া গাধার মধ্যে একজনের নাম লোকমান হোসেন। অন্যজন আরজত আলী। লোকমান হোসেন গলা খাঁকারি দিলেন। এর মানে কী? উন্মুক্ত টাট্টিখানায় বসে প্রকৃতির ডাকে সাড়াদানকারীরা হঠাৎ কোনো অনুপ্রবেশকারীর উপস্থিতি টের পেলে এ ধরনের শব্দ করে। দবিরউদ্দিনের মনে হলো, শুধু গাধা বললে এ লোকের যথার্থ মূল্যায়ন হয় না।
সাগরের চেয়েও বড় জলাধারকে বোঝাতে যেমন মহাসাগর বলা হয়, মহা শব্দ যোগ করে এ লোকটাকেও মহাগাধা বলা উচিত। মহা শব্দটি যোগ করার পর গাধার আকার-আয়তনে কতটা পরিবর্তন এলো, দেখার জন্য দবিরউদ্দিন চোখ খুললেন। লোকমান হোসেন এ মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি চোখ টিপে দবিরউদ্দিনের উদ্দেশে বললেন-
: স্যার কি ঘোড়ার মতো স্ট্যান্ডিং অবস্থায়ই ঘুমাইয়া পড়ছিলেন?
দবিরউদ্দিন এবার ফুসফুস উজাড় করে হাওয়া নির্গত করলেন। তার চোখ বন্ধ ছিল বড়জোর দুই মিনিট। এ দুই মিনিটকে ঘুমের আবরণে ঢেকে ফেলার চিন্তা মহাগাধা ছাড়া আরও কার মাথায় আসা সম্ভব নয়। তিনি বিরক্তি গোপন করে বললেন-
: সবকিছু বাদ দিয়া ঘুমের ভাবনা আপনের মাথায় কীজন্য উদয় হইল, বলেন তো!
লোকমান হোসেন হা-হা করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি শেষ হওয়ার পর বললেন-
: স্যার, আজকাল দেখি মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ-দারোগাসহ দেশের সবাইরে ঘুমরোগে ধরছে। তাই ভাবলাম, আপনেও তার ছোঁয়া পাইছেন।
: লোকমান সাহেব, উল্টাপাল্টা না ভাইব্যা কাজের কথা ভাবেন।
এ কথার সূত্র ধরে আরজত আলী মুখ খোলার সুযোগ পেলেন। তিনি প্রবল উৎসাহ নিয়ে বললেন-
: স্যার, সাবজেক্টের চাইরপাশে চক্কর মারতে মারতে আমার একটা ধাঁধা মনে পইড়া গেছে। বলব?
দবিরউদ্দিন আবেগহীন কণ্ঠে বললেন-
: বলেন।
: মগডালে বসবাস চৌডালে বাসা; শিকার যে শিকারী হইল, কী আচানক কথা! এর মানে বলতে পারবেন স্যার?
: জি, না।
: আমি বলতেছি। এর মানে হইল-এক ঈগলপক্ষী একটা বিড়াল শিকার কইরা বাসায় লইয়া গেছে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য। সে বিড়ালটারে বাচ্চাদের সামনে রাইখ্যা নতুন শিকার ধরার জন্য উড়াল দিতেই বিড়াল বাবাজি ঈগলের বাচ্চা দুইটারে গপাগপ খাইয়া চম্পট মারল। এইটাই হইল এই ধাঁধার মূল থিম- শিকার যে শিকারী হইল, কী আচানক কথা! আমাদের তদন্তেও এই একই বিষয়ের ওপর লাইট মারতে হবে। আমাদের সাবজেক্টও জাস্ট কারও কারও বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার একটা শিকার ছিল। কিন্তু এখন আমরা অত্যাশ্চর্য হইয়া দেখতে পাইতেছি- সে হঠাৎ শিকারীর বেশ ধারণ কইরা একজন মানুষের প্রাণ হরণ কইরা ফেলছে।
আরজত আলীর ঈগল-বৃত্তান্তের পর লোকমান হোসেন শুরু করলেন মোহাম্মদ আলী বৃত্তান্ত। তিনি বললেন-
: স্যার, আমি একটু অন্য অ্যাঙ্গেলে চিন্তা করতেছি।
: কী রকম?
: স্যার, আমি মনে করি, দুর্ঘটনায় ইন্তেকালকারী ছিল আকাইম্যা মোহাম্মদ আলী। তার নাম মোহাম্মদ আলী হইলেও সে এই নামের ধারেকাছেও ছিল না। মোহাম্মদ আলী মানেই ঢিসুম-ঢাসুম। বাঘটা যখন তার দিকে কাইত হইতেছিল, তখন সে বক্সার কিং মোহাম্মদ আলীর মতো প্রতিরোধের চেষ্টা করে নাই। নীরবে মাথা পাইত্যা দিছে।
ধমক দিতে গিয়েও দবিরউদ্দিন নিজেকে নিরস্ত করলেন। বললেন-
: লোকমান সাহেব, লোকটা মাথা পাইত্যা দেয় নাই। সে তখন ঘুমাইতেছিল।
: এটাও একটা পয়েন্ট স্যার। বাসা রাইখ্যা সে রাস্তায় ঘুমাবে কেন? কোনো নাগরিকের রাস্তায় ঘুমানোটা মধ্যম আয়ের একটা দেশের জন্য চরম অপমানের। দেশের বুকে এই রকম একটা কলংকচিহ্ন আঁইক্যা দেওয়ার অপরাধে এই লোকের মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত।
দবিরউদ্দিনের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কথা না বললে লোকমান হোসেনের গাধামি মেনে নিতে হবে। মূলত এ পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য দবিরউদ্দিন বললেন-
: লোকটা ইচ্ছা কইরা রাস্তায় ঘুমায় নাই লোকমান হোসেন সাহেব। বৃষ্টির কারণে সে ওইখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হইছিল।
: এইটাও একটা পয়েন্ট স্যার। রিমঝিম বৃষ্টি, রোমান্টিক পরিবেশ। সে ইজিলি বাসায় যাইয়া তার বউয়ের সঙ্গে সময় কাটাইতে পারত। তা না কইরা সে ওই চিপার মধ্যে ঢুকছিল কোন নিয়তে, সেইটা খুঁইজ্যা বাইর করা দরকার।
আরজত আলী আবারও মুখ খোলার সুযোগ পেলেন। তিনি বললেন-
: এর কারণ তার বাসস্থান। সে হাজারিবাগ এলাকায় একটি বস্তিতে বসবাস করলেও ওইখানে তার ভালো লাগত না। তাই সে বিবাগী হইয়া রাস্তায় মধ্যেই গোয়িং টু টয়লেট, গোয়িং টু রোমান্স, গোয়িং টু স্লিপ ইত্যাদিতে লিপ্ত হইছিল।
দবিরউদ্দিন একটু দূরে চলে এলেন। বোঝাই যাচ্ছে, এখানে বড়মাপের দুর্নীতি করা হয়েছে। এ দুর্নীতির সঙ্গে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসাধু লোকজন জড়িত। এর সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও রয়েছে। রিপোর্টে দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করার বিষয় এ দুটিই। কিন্তু তাতে লাভ কী?
রিপোর্টে দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করা যে কথা; গরুর রচনা লেখাও একই কথা। যারা এ দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য দায়ী, তদন্ত রিপোর্ট তাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি? মনে হয় না। ঠিকাদার আগের নিয়মেই বিল উত্তোলন করবে, সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাবে; শুধু দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার ও স্বজনদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে দুঃসহ যন্ত্রণার ঘূণাবর্ত-দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর...
লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস