যেখানে ফুল আর বই এক সুরে বাজে
বইমেলা। সকালের কচি সোনা রোদে শীতের কাঁটাচেরা ভালোবাসা যখন বলছে বাই বাই তারই ধার ঘেঁষে বসে বইয়ের মেলা। আসলে তো বই নয় সে এক প্রাণের মেলা। প্রাণে প্রাণে মিলনের মেলা। কত প্রাণ এক হয় এখানে এসে তা শুধু লেখক পাঠক আর প্রকাশকই জানেন। আর জানে শত সহস্র বীর ভাষা শহীদ যারা দিয়ে গেছে প্রাণ এই ভাষা কইবার জন্য, এই ভাষা লিখবার জন্য, যাদের প্রাণ দেবার পথ হাঁটি হাঁটি পা পা করে নিয়ে এসেছে বাঙালিকে বাঙলা ভাষাভাষীকে এবং তারপর সমগ্র বিশ্বকে আজকের এই বিশাল প্রয়াসে। তাদের জানাই শত শ্রদ্ধা আর প্রণাম।
আমি তখন বাস করি ময়মনসিংহে। বই এর প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এল। ঘরে মা। তারপর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম বইপড়া প্রতিযোগিতা। তারও বাইরে আরও দূরে আরও ব্যাপ্ত বইমেলা। এই বুঝি আমাদের জীবন। বই ছাড়া বাঁচেনা পরান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে বইমেলায় যাতায়াত আমার প্রতিদিন। ক্লাস শেষ ছুটি বইমেলায়। বন্ধুরা কেউ কোনো স্টলে কাজ করলে তো কথাই নেই। সেখানে জম্পেস আড্ডা প্রতিদিনই। সারাটা মাস আড্ডা মেরে বইকেনা শুরু হতো শেষের ক’দিন। ছাত্রদের অত পয়সা দিয়ে বই কেনার সামর্থ নেই। তাই যখন কনসেশন সর্বোচ্চ তখনই বই কিনবার প্ল্যান থাকতো আমাদের। বই এর স্টল ঘিরে আড্ডা আর মেলা শেষ হওয়া অবধি বই শুঁকে শুঁকে সময় যাপন। এক অসাধারণ আনন্দমুখর দিন ছিল তখন। তখন বাংলা একাডেমির বই মেলার সীমানার শুরু ছিল টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত। যদিও টিএসসি ঘেঁষা রাস্তার দিকটাতে আবৃত্তির ক্যাসেটের স্টলই বেশি বসতো। মেলা ঘিরে সব নামী দামী লেখকের উপস্থিতিটাই আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। মেলার প্রথম দিকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম তাঁদের। এতকাল ধরে যে বড় বড় শিল্পী সাহিত্যিক আর কবিদের কবিতা পড়েছি তাঁদের কতজনকে চোখের সামনে দেখতে পাই ঠিকই কলাভবনে ক্লাসরূমে। বাকিদের দেখি বইমেলায়। কতজনের অটোগ্রাফে যে ডায়েরির পাতা ভারি করি তার যেন শেষ নেই। সে এক দারুণ আনন্দের দিন।
তারই মাঝে কোনো কোনোদিন ঘটতো অনভিপ্রেত কিছু ঘটনা। সে ছিল চাঁদের কলঙ্করেখার মতো। সব শুভের সাথে যেমন কালো ছায়া মিশে থাকে। তেমন। পৃথিবীতে সব সুন্দরের সাথে যেমন নারীর তুলনা। সুন্দরকে কলঙ্কিত করবার জন্য প্রথম টার্গেটও তেমনি নারী। বইমেলায় ঢুকবো। টিএসসিতে আবৃত্তির ক্যাসেটের স্টল থেকে গ্রুপের ক’জন ছেলেমেয়ে, সিনিয়র, জুনিয়র একসাথে চলেছি। জমাট ভিড়ের মধ্যে যাচ্ছি বাংলা একাডেমির দিকে। হঠাৎ ঘটে যায় অনভিপ্রেত ঘটনা। আর অমনি আমাদের এক সিনিয়র আপা পায়ের হাইহিল জুতো খুলে হাতে নিয়ে চিৎকারের সাথে দৌড় শুরু করলেন, ‘‘ও কে ধরুন, ওকে ধরুন। ও আমার বুকে হাত দিয়েছে।’’ সেদিন সে কাপুরুষ দৌড়ে পালিয়েছিল বৈকি। আর কিছু নপুংসকও দাঁত বের করে হেসেছিল। ভুলিনি সে হাসি। কিন্তু নারীর সে অসম সাহস ছিঁড়তে পারেনি কাপুরুষের বিকৃত যৌনরূচিবোধ। বুকের নিভৃতে জমাট কালো অন্ধকার হয়ে জমে আছে আজো যে কলংক। বইমেলার মতো পবিত্র ভালোবাসার স্বর্গে। সেখানেই ঘটে পরবর্তীতে আরো আরো বীভৎসতা। পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম ঘটনা। খুন। মৃত্যু। নেমে আসে বই এর মেলায় আকালের করাল গ্রাস। ক্রমে ক্রমে- ঘাতকের অস্ত্র চির চির করে চিরে ফেলে প্রাণপ্রিয় স্যার হুমায়ুন আজাদের শরীর। রেখে দেয় মেলার অদূরে অভিজিতের রক্তাক্ত শরীর। আলগা করে নেয় অভিজিতের স্ত্রীর শরীর থেকে লিখবার আঙুল।
আজ বড়ো ব্যথা এই বুকের ভেতর। এই শরীরে। এই মনে। বোধ করি একই বেদনা আমার ভাষা শহীদ ভাই বোন আর জীবিত শত শত শব্দসৈনিক যোদ্ধা আর দেশপ্রেমিক অজস্র মূক ক্ষমতারহিত সাধারণ মানুষের মনে। যেখানে নবীন আর প্রবীণ এক হয়ে যান, যেখানে শিশু আর যুবকের প্রেম এক হয়ে আসে, যেখানে ফুল আর বই এক সুরে বাজে যেখানে বাতাসও নিষ্ক্রিয় থাকে মেঘবারি থেকে মানুষের সঘন আর অন্তরতম নির্বিঘ্ন আসা যাওয়া সচল রাখতে। যখন মেলার শেষদিকে বসন্ত নিয়ে আসে ফুলের ডালি। মনকে সুরভিত করে তোলে একই সাথে নতুন বই’র পাতা আর ফুলের সুবাস তখন হায়েনারা বুঝি আড়পেতে থাকে কখন আসবে সুযোগ বসিয়ে দিতে করাল কোপ কোন সচল বুদ্ধিজীবীর মাথায়। বুকের ভেতর এই যাতনা এই দুশ্চিন্তা আর এই সব ক্ষয় নিয়ে ভাবছি এবারের বই মেলা কতটা আনবে শুভ। আসুন এবারই সোচ্চার হই সব অসুরের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ আর একবার শুরু হোক, যেখানে মৃত্যু দিয়ে জয় লিখে গেছেন প্রিয় লেখক অভিজিত রায় আর প্রিয় হুমায়ুন আজাদ স্যার।
শুভ হোক বইমেলা। শুভময় হোক সব প্রাণ ভালোবাসায় জ্ঞানে আর বিশুদ্ধ দেশপ্রেমে।
লেখক : সংস্কৃতিকর্মী, কবি
এইচআর/এমএস