একের পর এক ঘটছে, তবুও ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা?

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১৯ জুলাই ২০২২

দেশে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এক ধরনের পরিকল্পিত হামলার ঘটনা ঘটছে। এর একটি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্নও দাঁড়িয়ে গেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেবে, তাতে ধর্মকে অবমাননা করা হবে, এখানে ধর্ম মানে অবশ্যই ইসলাম ধর্ম, তারপর তৌহিদি জনতা জেহাদি জোশে নেমে পড়ে এবং হিন্দুদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ চলে। রেহাই পায় না উপাসনালয় বা মন্দিরও।

সেই রামু থেকে শুরু করে আপাত সর্বশেষ ঘটনা নড়াইলে। এরপর নিশ্চয়ই অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এক মাসের ব্যবধানে নড়াইলে দুটি ঘটনা ঘটলো। এক কলেজশিক্ষার্থীর ফেসবুক বার্তাকে কেন্দ্র করে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়ায় যা ঘটেছে, তা সর্বার্থে নিন্দনীয়। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে নড়াইলে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয়বারের মতো অঘটন ঘটলো।

গত ১৮ জুন নড়াইল সদর উপজেলার ইউনাইটেড কলেজের এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক বার্তাকে কেন্দ্র করে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে চরমভাবে অপদস্থ করা হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল ব্যাপক সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে। এমনকি ধারেকাছেই জেলা প্রশাসকসহ পুলিশের বড় কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

কেউ কলেজে ওই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মর্যাদা রক্ষার গরজবোধ করেননি। অথচ তিনি কিন্তু ফেসবুকে কিছু লেখেননি। কারও অনুভূতিতে পরোক্ষভাবে কোনো আঘাত দেননি। তার কলেজের একজন ছাত্র একটা পোস্ট দিয়ে নাকি ভারতের বিতর্কিত এক নেত্রী নূপুর শর্মাকে সমর্থন করেছে বা ওই রকম কিছু একটা। তো, দোষ যদি কিছু করে থাকে তাহলে করেছে ওই ছাত্র। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অধ্যক্ষকে অপমান করলেন কেন? আচ্ছা, তিনি কি অধ্যক্ষের দায়িত্ব জোর করে নিয়েছিলেন? দায়িত্ব পালনে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন?

না, এসবের কিছুই নয়। তাহলে তার গলায় জুতার মালা কেন? কারণ ওই কলেজের একজন শিক্ষক, যিনি আবার একই সঙ্গে আওয়ামী লীগেরও একজন নেতা, তিনি চাইছিলেন স্বপন বিশ্বাসকে সরিয়ে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসতে। কোনোভাবেই স্বপন বিশ্বাসকে নিয়ে মানুষের মনে অবিশ্বাস তৈরি করতে না পেরে শেষে পেয়ে যান বিরাট মওকা। ধর্ম অবমাননা। তা-ও আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম– ইসলাম নিয়ে কটূক্তি।

স্বপন বিশ্বাস নিজে করেননি, তাতে কি আরেক হিন্দু, সে আবার স্বপন বিশ্বাসের ছাত্র সে তো করেছে, তাই শাস্তি স্বপন বিশ্বাসকে পেতেই হবে। শাস্তি তো হলো। কিন্তু তাকে তো এখনো পদচ্যুত করা হয়নি। ঘটনার পর থেকে স্বপন বিশ্বাস বাড়িছাড়া। আশা করা যায়, অচিরেই তিনি দেশ ছাড়া হবেন। ভিন্ন ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করলে সম্প্রীতি রক্ষা করে চলা একটু কঠিন বই কি! বরং দেশটা এক ধর্মের মানুষের নিরাপদ বাসস্থান হলে সম্প্রীতিটাও মজবুত হয়। কারণ সব মুসলমান ভাই ভাই, হানাহানির শঙ্কা নেই। তাই তো নাকি?

স্বপন বিশ্বাসের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১৫ জুলাই শুক্রবার আবার একই ধরনের ফেসবুক বার্তাকে কেন্দ্র করে লোহাগড়ার দিঘলিয়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুর এবং বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। যাদের বাড়ি ভাঙচুর করা হয় কিংবা আগুন দেওয়া হয়, ওই ফেসবুক বার্তার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত কলেজছাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, এ অজুহাতেই সেখানে অন্য সংখ্যালঘুর বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে কোনো ধর্মকে অবমাননা করার অধিকার যেমন কারও নেই, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করার অধিকারও কাউকে দেওয়া হয়নি।

খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। এখানে প্রশ্ন হলো, আকাশ সাহা কি সত্যি ফেসবুকে এমন কোনো পোস্ট দিয়েছে, যাতে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করা হয়েছে? এটা তো অভিযোগ। এই অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার আগেই কেন প্রতিক্রিয়া? এর আগে এমন কোনো অভিযোগ কি সত্য বলে প্রমাণ হয়েছিল? আকাশ সাহাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তদন্তে যদি এটা প্রমাণ হয় যে অভিযোগ মিথ্যা, ভুয়া একাউন্ট খুলে অন্য কেউ বিশেষ মতলবে দুরভিসন্ধিমূলক পোস্ট দিয়ে হিন্দুদের ওপর হামলার প্লট তৈরি করেছে, তখন কি বলা হবে?

হামলার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল। জেলার পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছিলেন। এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু ঘটনাস্থলে থেকে তারা কি করেছেন? হামলাকারীদের নিবৃত্ত না করে দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন? একজন আক্রান্ত হিন্দু নারী বলেছেন, যখন একের পর এক গ্রামের হিন্দু পুরুষদের মারধর করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ ছিল। তারা দূরে থেকে দেখছিল। কাউকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। পুলিশের ওপর তাই আস্থা রাখা যায় না। গ্রামের মানুষ তাই এলাকা ছেড়েছে।

এটাই তো হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য, নাকি? প্রথমে এলাকা ছাড়া, তারপর দেশ ছাড়া! হায়রে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ। পাড়ায় পাড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করার পরও এ রকম হামলার ঘটনা কীভাবে ঘটে, সে প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশাসনের কতজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতসংখ্যক সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল, সেটি জেনে আমাদের কি লাভ? তারা যদি উপস্থিত থেকে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঠেকাতে পারতেন, তাহলে তাদের বাহবা দেওয়া যেতো।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আক্রমণকারীরা সংখ্যায় বেশি ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলের মধ্যে তারা ১০ থেকে ১২ জন করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে। এ খবর যদি সত্য হয়, তাহলে প্রশাসন এ হামলার দায় এড়াতে পারে না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব, যা তারা পালন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা আর সদলবলে কোনো ধর্মের মানুষের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এক কথা নয়। নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।

যারা লোহাগড়ায় সংখ্যালঘুর বাড়িঘরে হামলা ও আগুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। রামু, নাসিরনগর ও সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার এসব ঘটনায় কেউ শাস্তি পায়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে প্ররোচিত করছে। গত বছর অক্টোবরে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলায় দুর্গামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর ঘটনায় কোনো মামলার তদন্ত কি ৯ মাসেও শেষ হয়েছে? মামলায় গ্রেফতার হওয়া বেশির ভাগ আসামি এখন জামিনে আছেন।

এসব মামলায় বিচারে কারও শাস্তি হবে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে আইনজীবী ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, মামলাগুলো হচ্ছে দায়সারাভাবে। মামলা করে ভুক্তভোগীদের সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে। আবার অপরাধীদের নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে, এসব মামলায় তাদের কিছুই হবে না। আর তাই মামলা থেকে প্রকৃত অপরাধীরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে।

দায়মুক্তির এই ধারা অব্যাহত থাকলে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হিন্দুদের ওপর হামলা অব্যাহতই থাকবে। আজ এখানে, কাল অন্যখানে। হিন্দুদের মধ্যে যারা এগুলো আর সহ্য করতে পারবে না, তারা ভিটেমাটি ছাড়বে আর যাদের সহ্য না করে উপায় নেই এবং যতদিন তাদের গলার ওপর মাথাটা থাকবে, তারা দেশপ্রেমিক হিসেবে থেকে যাবেন এবং মন্দিরে-মণ্ডপে গীত গাইবেন: ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।

আচ্ছা, সংখ্যালঘু বা হিন্দুদের কি ধর্ম নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই? হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুদের দেবদেবী সম্পর্কে কত কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ইসলামী জলসায় প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়, তার জন্য কি হিন্দুদের পক্ষ থেকে কখনো কারও ওপর হামলার ঘটনা একটিও ঘটেছে?

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে এটা কারও কল্পনায়ও আসার সুযোগ নেই যে, সংখ্যালঘুদের ধর্মকে কটাক্ষ করে কিছু বলার অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা এসে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা করেছেন কিংবা বাড়িঘর ভাঙচুর করেছেন? সে রকম ঘটনা ঘটলে তো দেশে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যাবে! আমরা তাই চাইবো, সংখ্যালঘুরা অনবদমিতই থাক, মাথা নিচু করে সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলায় অভ্যস্ত হোক।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে এটা কারও কল্পনায়ও আসার সুযোগ নেই যে, সংখ্যালঘুদের ধর্মকে কটাক্ষ করে কিছু বলার অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা এসে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর হামলা করেছেন কিংবা বাড়িঘর ভাঙচুর করেছেন? সে রকম ঘটনা ঘটলে তো দেশে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যাবে! আমরা তাই চাইবো, সংখ্যালঘুরা অনবদমিতই থাক, মাথা নিচু করে সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলায় অভ্যস্ত হোক।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।