আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দে...
: সৈকত ভাই!
: জি বলেন।
: আপনি কি এ মুহূর্তে অভিভূত হতে চান?
: অভিভূত বা দ্রবীভূত- কোনোটাই হতে চাই না।
: তাহলে?
: যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাই।
: বলেন কী! কিসের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে চান?
: আপনার।
: ও! ভাই কী মাইন্ড করছেন?
: কিছুটা।
: আমি আরও ঠিক করে রেখেছিলাম, ফাস্টে আপনাকে দেখাব!
: কী দেখাবেন?
: ময়না।
: ময়না?
: হ্যা, ময়না। একদম খাটি পাহাড়ি ময়না। আজ সকালেই কিনছি।
: ময়না দিয়ে কী হবে?
: অভিভূত হবার ব্যাপারটা তো এখানেই! আগে ময়নাটা দেখেন। আনব?
: কী আর করা! আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, অই বস্তুটা না দেখিয়ে আপনি ছাড়বেন না। আনেন দেখি।
: থ্যাঙ্ক ইউ সৈকত ভাই।
মিনা হাউজের নিচতলার তিনটি রুমে আমরা থাকি মোট ৬ জন। প্রতি রুমে দু’জন করে ব্যাচেলরের সহাবস্থান। এই ৬ জনের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করছে নান্দাইলের লিয়াকত; উত্তরের রুমটায় পিয়াল-এর সঙ্গে যে থাকছে আজ প্রায় মাস ছয়েক হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর লিয়াকত একটি বেসরকারি ব্যাংকে প্রবেশনারী অফিসার হিসাবে যোগ দিয়েছে এবং অতি সম্প্রতি এক তরফা প্রেমে পড়েছে মিনা হাউসের ঠিক বিপরীতমুখী বাসার দোতলার জনৈকার সঙ্গে। ওর এই প্রেমে পড়া নিয়ে আমরা বাকিরা সবাই এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলেও ও যে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে, তার স্বাক্ষর ইতোমধ্যে সে রেখেছে স্ব-সংঘটিত একাধিক কার্যকলাপে। কিন্তু হঠাৎ লিয়াকতের ময়নাপ্রেমী হয়ে ওঠার রহস্য কী? নাহ! কোনো দিশা পেলাম না। লিয়াকত তার ময়নাসমেত খাঁচাটি বারকয়েক আমার চোখের সামনে দুলিয়ে বলল-
: লুক।
: হু, দেখলাম।
: কী বুঝলেন?
: দেখে তো মনে হচ্ছে ময়নাই; কিন্তু এ যে একেবারে বাচ্চা!
: হেঃ হেঃ হেঃ। হাতেখড়ি দেওয়ার জন্য এই বয়সটাই তো উপযুক্ত।
: হাতেখড়ি! ময়নাকে আপনি ইশকুলে পাঠাবেন নাকি?
: স্কুলে ঠিক পাঠাব না; তবে শিক্ষিত করে তুলব।
: কী রকম?
: বলেছিলাম না, আপনাকে অভিভূত করে দেব?
: রহস্য না করে বলুন তো, ব্যাপারটা আসলে ঠিক কি ঘটতে যাচ্ছে?
: আমার ময়নাকে আমি এখন থেকেই একটি মাত্র বাক্য-আমি তোমাকে ভালোবাসি কণ্ঠস্থ করাব।
: তারপর?
: তারপর পাঠ শেষে জানালার ধারে রেখে দিয়ে ময়নাকে বলব- সামনের বাসার জানালায় কোনো মুখ দেখলেই...; হেঃ হেঃ হেঃ। অনামিকা, সাড়া না দিয়ে তুমি যাবে কোথায়? কী, আইডিয়াটা কেমন?
: সত্যিই অভিভূত হবার মতো। কিন্তু নাম জানলেন কিভাবে? আলাপ হয়েছে নাকি?
: নারে ভাই, নাম জানতে পারিনি এখনো। নাম জানলে কী আর অনামিকা বলি?
পরদিন থেকেই লিয়াকতের ময়না-প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেল- ‘কও ময়না কও, আমি তোমায় ভালোবাসি। ' মাঝখানে প্রায় দেড় মাসের মতো পেশাগত কারণে ঢাকার বাইরে ছিলাম। ফিরে আসার পর লিয়াকতকে কেমন জানি উদাস উদাস মনে হচ্ছিল! একথা-সে কথার পর জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনার ময়না বিষয়ক খবর বলেন।
: খবর খারাপ।
: খারাপ! কেন কী হয়েছে?
: কী আর হবে! সবই এই কপাল। বুঝলেন, অভাগা যেদিকে চায়...
: ময়না কি খাঁচা থেকে উড়ে গেছে?
: নাহ্! উড়ে নাই; আমিই উড়াইয়া দিছি।’
: বলেন কী? হঠাৎ...
: ব্যাপারটা হঠাৎই ঘটল। আপনি সিলেট যাবার পর একদিন কাঁচাবাজারে গেছি। দেখি, ব্যাগ হাতে আমার সেই অনামিকা দাঁড়ানো।
: তারপর?
: ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়ে আপনার নামটা...
: বলল? প্রথমে কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।
: তারপর বলল, আমার নাম জমিলা।
: জমিলা?
: আহা শুনুন না! নাম শুনে দিলে জবর চোট খেলেও ভাবলাম, নামে কিবা আসে যায়?
নামটা একটু হেঁটে দিয়ে মিলা বলে ডাকব। কিন্তু...
: কিন্তু কী ?
: কিন্তু এরপর যে তথ্য উদঘাটিত হলো...
: যেমন?
: নাম-পর্ব শেষে লেখাপড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই ফ্যাচ করে হেসে বলল, আমি অই বাসাত কাম করি।
: স্ট্রেঞ্জ!
: আরও একটু বাকি আছে। এ কথা শুনে সেদিন বাজার না করেই মেসে ফিরে আসার পর দেখলাম- আমার ময়নাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা!
: জটলা?
: হ্যা জটলা। বাজারে যাওয়ার আগে বুয়াকে বলে গেছিলাম, ময়নাকে গোসল দেওয়ার জন্য। গোসল দিতেই চিচিং ফাঁক। তাই নিয়ে সবার বৈঠক; হাসি-ঠাট্টা, রঙ-তামাশা।
: বুঝলাম না!
: ওইটা অরিজিনাল ময়না ছিল না সৈকত ভাই। শালিকের বাচ্চারে রং দিয়া ময়না কইয়া আমার কাছে বেইচ্যা গেছে হারামজাদা!
: এত বড় প্রতারণা?
: হাঃ সৈকত ভাই! নিয়তি আমার সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে তার তুলনায় এইটা তো কিছুই না।
: তো এরপর ময়না; স্যরি, শালিকটাকে আপনি উড়াইয়া দিলেন। ঠিক কিনা?
: ঠিক। উড়াইয়া দিয়া কইলাম- যা শালিকের বেটি, যা। আমার হৃদয় খানখান করা বেদনার এই কাহিনি যদি পারস, আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দে...
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/জিকেএস