পড়তে এসেছি, মরতে নয়
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার বিখ্যাত কবিতা ‘ছাড়পত্রে’ লিখেছেন;
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ।
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
জাতির কারিগরদের উচিত কবি সুকান্তের সুরে সুর মিলিয়ে ‘প্রাণপণে পৃথিবীর জঞ্জাল সরানোর অঙ্গীকার করা। বিশেষ করে শিশুর বাসযোগ্য একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্য। যেটি সবারই কাম্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের শিশু-কিশোররা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলছে। তাদের কাঁধে চেপেছে বিদ্যার ভার। অনেক ক্ষেত্রে বয়সের চেয়ে বিদ্যার ভার বেশি।
শিক্ষার্থীদের বয়সের তুলনায় পাঠ্যবই এত বেশি থাকে যে তা একজন শিশু-কিশোরের পক্ষে বয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অভিভাবকরাও এই ইঁদুর দৌড়ে শামিল হন। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত প্রত্যাশা জন্মে। শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এজন্য আশপাশের সবচেয়ে ভালো বা নামকরা প্রতিষ্ঠানে (যে স্কুলে যত শাসন, যত বেশি টাকা বেতন, যত বেশি পাঠ্যবই সেটিকেই ভাল প্রতিষ্ঠান মনে করা হয়।) সন্তানকে না পড়ালে যেন জীবন বৃথা। এই চাওয়া-পাওয়ার যাঁতাকলে পড়ে শিক্ষার্থীর জীবন হয়ে পড়ে অতিষ্ঠ। একদিকে স্কুলের চাপ, অন্যদিকে অভিভাবকের আকাশসম প্রত্যাশা। মাঝখানে গিনিপিগ শিক্ষার্থীরা। এই সুযোগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো-যেগুলোকে আসলে শিক্ষাবাণিজ্যের জন্যই সৃষ্টি করা হয়-তাদের অবস্থা রমরমা। এই বাণিজ্য এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে কোনো উপায়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিদ্যা গেলানো হবে। এতে তার জীবন থাক বা না থাক- সেটি বিবেচ্য নয়। বাণিজন্যই প্রধান।
টাঙ্গাইলের শিশু শিহাবের অপমৃত্যু কি শিক্ষার এই বাণিজ্যিকীকরণের ফল? টাঙ্গাইলের সৃষ্টি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া শিশু শিহাবের (১২) মরদেহ গত ২০ জুন আবাসিক ভবনের সাততলার বাথরুমের একটি কক্ষ থেকে পুলিশ উদ্ধার করে। এরপর থেকেই শিশুটির মৃত্যু নিয়ে নানা আলোচনার জন্ম দেয়। শিহাব জেলার সখীপুর উপজেলার বেড়বাড়ি গ্রামের প্রবাসী ইলিয়াস হোসেন ও আসমা আক্তার দম্পতির একমাত্র সন্তান।
শিশুর পরিবারের দাবি তাকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে সাজিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। আর স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি শিশুটি আত্মহত্যা করেছে। রোববার (২৬ জুন) জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে গলাটিপে বা শ্বাসরোধ করে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরপরই রোববার পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই স্কুল ভবনে অভিযান চালিয়ে টাঙ্গাইলের সৃষ্টি স্কুলের অধ্যক্ষসহ ৯ শিক্ষককে আটক করেছে।
শিহাবের বাবা ইলিয়াস হোসেনের ভাষ্যমতে, 'বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে দেশে বাচ্চাকে ভালো শিক্ষার জন্য যাদের কাছে দিয়েছিলাম তাদের কাছ থেকে সন্তানকে লাশ হিসাবে ফেরত পেয়েছি। আমার বাবারে ওরা মাইরা ফেলছে। স্কুলটি মানুষ গড়ার কারখানা নয়, টাকা কামানোর কারখানা! আমার সন্তানকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।’
শিহাবের মা আসমা আক্তারের দাবি- ‘আমার সন্তান কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারে না, আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই’। শিহাবের মা-বাবার আহাজারিতে গোটা এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। সন্তান হারানোর শোকে শিহাবের বাবা-মা বাকরুদ্ধ। তাদের আহাজারিতে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। এমন মৃত্যু কিছুতেই কাম্য নয়।
শিহাব হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকা। বিচার দাবিতে অভিভাবক-শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষেরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ করছেন। রাজু ভাস্কর্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত টাঙ্গাইলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে। এসব মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে সৃষ্টি স্কুলের ছাত্রাবাসে শিশু শিক্ষার্থী শিহাবের হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করা হয়। এবং সৃষ্টি স্কুল-কলেজ বন্ধ করার দাবি করা হয়।
গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে, স্কুলের আবাসিক ভবনের যেখানে শিহাব থাকত, সেখানে তার পরিবারের কাউকে যেতে দেওয়া হতো না। তাকে হত্যা করে আত্মত্যা বলে ধামাচাপার নানা ফন্দি স্কুল কর্তৃপক্ষ করেছিল।
মৃত্যুর চার মাস আগে সৃষ্টি একাডেমিতে পঞ্চম শ্রেণিতে শিহাব মিয়াকে ভর্তি করা হয়। শিহাবের দাদা ইসমাইল হোসেনের ভাষ্য, ‘বাড়ি থেকে যোগাযোগের জন্য ফোন করা হলে সব সময় শিহাবকে পাওয়া যেত না। সৃষ্টি কর্তৃপক্ষ শিহাবের হাতে ফোন দিত না। বিষয়টি খুব রহস্যজনক ছিল।’
শিশু শিহাব হত্যার বিষয়ে নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। যে কক্ষে শিহাব থাকতো সে কক্ষে বাথরুম থাকলেও শিহাবের মরদেহ পাওয়া গেছে একই ফ্লোরের অন্য একটি বাথরুমে। শিশু শিহাব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে টাঙ্গাইলসহ সারা দেশে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শিশুটির ছবি দিয়ে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন নেটনেটিজেনরা। এমনকি ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধেরও দাবি করছেন তারা। সৃষ্টি স্কুল-কলেজে অনেক শাখা রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। অভিযোগ রয়েছে, সৃষ্টি শিক্ষা পরিবারের কর্ণধার বহু অর্থের মালিক বনে গেছেন শিক্ষাবাণিজ্যে।
শিশু শিহাবের কী অপরাধ ছিল তাকে এভাবে জীবন দিতে হল? আমরা চাই শিহাব হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন হোক। শিহাবের মতো আর কোনো শিশু যেন এভাবে নির্মমতার শিকার না হয়। আর কোনো মা-বাবার বুক যেন খালি না হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আমরা আশা করবো তদন্তে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে। আর সে অনুযায়ী দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হবে।
বন্ধ হোক শিক্ষার নামে বাণিজ্য। আর কোনো শিহাবকে যেন শিক্ষাবাণিজ্যের শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে অকালে বিদায় নিতে না হয়। কবি সুকান্তের চাওয়ার মতো আমরা এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাব- এই হোক অঙ্গীকার।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/জেআইএম