রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা দিন
৭ জুন ছয় দফা দিবস। ১৯৬৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকে ছয় দফা দাবির পক্ষে হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সরকার হরতাল বানচালের সব ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থাই নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তারের স্টিমরোলার চালানো হলেও হরতাল বন্ধ করা যায়নি। ঢাকা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া শফিক শামসুল হকসহ কমপক্ষে ১১ জন নিহত হয়েছিলেন। শত শত নেতাকর্মী, সাধারণ পথচারী, এমনকি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের গ্রেপ্তার করে জেলখানা ভর্তি করা হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল ব্যাপক নির্যাতন চালালে মানুষ ভয়ে রাস্তায় বের হবে না। আন্দোলন দানা বাধবে না। ছয় দফা নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে না।
পাকিস্তানের মিলিটারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং তার বংশবদ পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনায়েম খানের হিসেবে ভুল ছিল। পূর্ব বাংলার মানুষ ততদিনে শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের পেছনে কাতারবন্দি হতে শুরু করেছে। শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে যতই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছে, জনগণ ততই শেখ মুজিবকে তাদের আপন করে নিয়েছে।
ছয় দফা কর্মসূচি শেখ মুজিব প্রথম ঘোষণা করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলনে। ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি ওই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৫ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিব ছয় দফা প্রস্তাব আলোচ্যসূচিতে যুক্ত করার জন্য উত্থাপন করেন। কিন্তু তার প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। বরং পরের দিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে ছয় দফার বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা করা হয়। এমনকি শেখ মুজিবকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী' বলেও চিহ্নিত করা হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ওই সম্মেলন বর্জন করেন।
১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব ও দাবি আদায়ের আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। ছয় দফার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য শেখ মুজিব বিভিন্ন জেলা সফর শুরু করেন। তার প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন লক্ষ করে শাসকগোষ্ঠী প্রমাদ গোনে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসার পথে না হেঁটে আইয়ুব খান এবং তার পরামর্শকরা সংঘাতের পথ বেছে নেন। অবশ্য ছয় দফা এমন একটি কৌশলী রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল যা মানা এবং না-মানা দুটোই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের জন্য দুরূহ।
কী ছিল ছয় দফায়? সংক্ষেপে ছয় দফা হলো :
এক. সরকারের বৈশিষ্ট্য হবে ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং সংসদীয় পদ্ধতির। অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশগুলোতে কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ ও সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে।
দুই. কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক বিষয়ে ।
তিন. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করা, যা উভয় অঞ্চলে বিনিময় করা চলবে।
বিকল্প হিসেবে একটি মুদ্রা ব্যবস্থা এই শর্তে চালু থাকতে পারে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুইটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। এমন বিধান থাকতে হবে যাতে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ বা মূলধন পাচার না হতে পারে।
চার. রাজস্ব ধার্য এবং আদায়ে ক্ষমতা থাকবে অঙ্গ বা প্রাদেশিক রাজ্যগুলোর হাতে। প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক বিষয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান দেওয়া হবে।
পাঁচ. প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে সেই অঙ্গরাজ্যের সরকার যাতে স্বীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে তার পৃথক হিসাব রাখতে পারবে।
ছয়. ফলপ্রসূভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলেকে মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।
পাকিস্তানি শাসকরা ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানের মৃত্যুবাণ দেখতে পেয়েছিল। তাই প্রথম থেকেই ছয় দফার বিরুদ্ধে নিয়েছিল যুদ্ধংদেহি মনোভাব। অন্যদিকে পাকিস্তানের দুই অংশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও ছয় দফার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। দক্ষিণপন্থি দলগুলো তো নয়ই বামপন্থিরাও ছয় দফার পক্ষে নামেনি। বামপন্থিদের মধ্যে চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত মওলানা ভাসানী এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা ছয় দফাকে সিআইয়ের দলিল হিসেবে প্রচারে নামে। মস্কোপন্থি বলে পরিচিত কমিউনিস্টরা ছয় দফার প্রতি নমনীয় থাকলেও ‘তবে', ‘কিন্তু’ শব্দ যুক্ত করে তাদের দোদুল্যমানতা প্রকাশ করেছে।
আওয়ামী লীগ ছয় দফাকে বাঙালির মুক্তির সনদ বলে উল্লেখ করেছিল। আর মস্কোপন্থিদের বক্তব্য ছিল : ছয় দফা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, স্বায়ত্তশাসনের দাবি হিসেবে ঠিক আছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া যুক্ত না করলে এটা পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক কর্মসূচি হবে না। তাদের বক্তব্যেও যুক্তি ছিল, কিন্তু এই যুক্তি তারা তাদের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে ৭ জুনের হরতাল সফল করতে গিয়ে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একজন ছাত্রকর্মী হিসেবে কারাবরণ করেছিলেন।
বিক্ষোভ বা জনরোষের স্বতঃস্ফূর্তি প্রকাশ এবং আন্দোলন এক বিষয় নয়। যেকোনো কারণে মানুষ হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। রাজপথে নেমে সহিংসতা-উদ্দীপনাও দেখাতে পারে। তবে এটা স্থায়ী হয় না। আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিণতি থাকতে হয়। সফল আন্দোলনের জন্য বিকল্প নেতৃত্বও থাকতে হয়।
শেখ মুজিবের মধ্যে মানুষ বিকল্প নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছিল। তাই তার ডাকে মানুষ সাড়া দিয়েছে। তবে তার এই অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সামনে থেকে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি দ্রুতই এটা উপলব্ধি করেন যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, সে পাকিস্তান আর তার কল্পনার পাকিস্তান এক নয়। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে বঞ্চিত করে, বাঙালিকে বৈষম্যের শিকার করে পাকিস্তান হচ্ছে পশ্চিমা ধনীদের এক নতুন শোষণ-বঞ্চনার লীলাখানা।
শাসক বদল হলেও শাসন পদ্ধতির বদল হলো না। তাই সময় ক্ষেপন না করে শেখ মুজিব তার নতুন রাজনৈতিক লক্ষ্য ঠিক করেন এবং সেই লক্ষ্য হাসিলের জন্য কৌশল অন্বেষণে পথে নামেন। তিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেন, অপশাসনের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেন।
পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার তিনি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বাইরেও কিছু ভাবেননি। তিনি তার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন অনেক নেতাকেই কেনা যায়, নেতারা নিজেদের সুখ-সুবিধার জন্য মানুষের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে ভুল করেন না। তিনি বুঝেছিলেন, মানুষ এমন একজন নেতার অপেক্ষায় আছেন, যে নেতা লোভ-প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ না করে মানুষের কথা বলবেন জেল-জুলুম উপেক্ষা করে মানুষের জন্য লড়বেন। শেখ মুজিব নিজেকে সাধারণ মানুষের বন্ধু, সঙ্গী এবং সহযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলার পথেই অবিচল থাকলেন।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝেছিল, পূর্ব দিগন্তে ঝড়ের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর ঝড় তোলার জন্য ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করে উঠে আসছেন একজন, তিনি টুঙ্গিপাড়ার মাটির সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো তিনি তার পেছনে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করছেন। সেটা পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত বাঙালি। তারা যেমন মুসলমান, তেমনি হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী।
ছয় দফার আন্দোলন যে ব্যাপক ব্যাপ্তি পেয়েছিল তার পেছনের বড় কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপস নেতৃত্ব। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তিনি কারাগারে ছিলেন। ৬৬ সালের ৯ মে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারাগারে বসেও তিনি আশাবাদী ছিলেন আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে। তিনি জানতেন - মানুষ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নেই, আছে তার সঙ্গে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের একক চেষ্টায় ৭ জুন সফল হরতাল পালন হওয়ায় শেখ মুজিব বুঝেছিলেন, সময় আসছে। বাঙালিকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। পাকিস্তানিরা শেখ মুজিবকে দাবিয়ে রেখে বাঙালিকে দাবাতে চেয়েছিল। ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করেও শেখ মুজিবকে দাবানো যায়নি, বাঙালিকেও না।
কিন্তু হায়! স্বাধীন দেশে বাঙালিরাই রচনা করলো কলঙ্কের ইতিহাস। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ, ভিন্ন আলোচনা। ছয় দফা দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক,কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম