ছাত্র সংগঠনের উগ্রতা উদারতা
ছাত্র রাজনীতি আর ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়ে চলছে বেশুমার আলোচনা। অতীতেও নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা হয়েছে এবারো হচ্ছে। এবারের উপলক্ষ্য গত ২৪ ও ২৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রদলের সংর্ঘষ। সংর্ঘষের উত্তাপ কেবলমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ, কার্জন হল কিংবা সুপ্রিম কোর্ট এলাকা নয়, ছড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনেও।
ঘটনার যে চিত্রসমূহ বিভিন্ন গণমাধ্যাম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফুটে উঠেছে সেগুলোকে কি বর্ণনাতীত নাকি গা সওয়া স্বাভাবিক বলা যায় বুঝতে পারছি না। একজন নারী সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, উপর্যুপরি মারধরে রাজপথে লুটিয়ে পরছেন,উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, আবারো লুটিয়ে পড়ছেন, দুই একজন তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন কিন্তু শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
আবার দেখা যাচ্ছে কোন একজন ব্যক্তিকে ১০-১২ জন মিলে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করছেন। এখানেই শেষ নয়, রড লাঠি এবং বাঁশ দিয়ে সাপের মতো পেটানো হচ্ছে কাউকে কাউকে। ইট পাটকেল নিক্ষেপ, দেশীয় অস্ত্র সস্ত্রের মহড়া, ব্যবহার, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, হামলা পাল্টা হামলার পাশাপাশি ঘটনার পর হয়েছে মামলা পাল্টা মামলা। ছাত্র সংগঠনগুলোর এধরনের আচরণ কোন পক্ষের জন্য কতটা মর্মবেদনার কারণ এ নিয়ে মতভেদ আছে ঠিকই তবে পারস্পরিক মন্তব্য বেশ চিরাচরিত, গতানুগতিক।
শাসকদলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রদল নামধারী অছাত্রদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে মাঠে নেমেছিলো। আর বিরোধীরা বলছেন, বিনা উস্কানিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় সব আমলেই ক্ষমতাসীন জোট কিংবা দলের ছাত্রসংগঠনের অতি উৎসাহ, শক্তি প্রদর্শন আর আধিপত্য বজায়ের চেষ্টাকে মনে না নিলেও আমাদের মেনে নিতে হয়।
যুগেরপরিবর্তনে এর ধার কমেনি এতোটুকু, পরিবর্তন হয়েছে ধরন, বেড়েছে মাত্রা। বিশেষ করে ৯০ পরবর্তী সময়ে এই প্রবণতা বাড়ে হারে হারে। দেশের ছাত্ররাজনীতি তথা ছাত্রসংগঠনের প্রতি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক সম্পর্কে ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনার আগে ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরতে চাই।
১৯৫২ সালের কথা, বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন সভাপতি। ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে একটি জরুরি চিঠি দিয়ে সেসময় নারায়ণগঞ্জে পাঠালেন, সাথে বাসভাড়া এবং দুপুরের খাওয়া বাবদ দিলেন আট আনার পয়সা। বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যায় ফিরে এসে ভাসানীকে সেই আট আনা ফেরত দিলেন। ভাসানী বললেন, তুমি যাও নাই। বঙ্গন্ধু বললেন, গ্যাছি।
ভাসানী: ক্যামনে গ্যালা?
বঙ্গবন্ধু: সাইকেলে, আমারতো সাইকেল আছে।
ভাসানী: খাও নাই?
বঙ্গবন্ধু: পার্টির পয়সায় খামু ক্যান।
অথচ আজ সেই বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনার চাইতে সমালোচনাই হচ্ছে বেশি। পরিস্থিতি প্রায় সকলেই অবগত, ক্ষেত্র বিশেষে দলও বিব্রত, কিন্তু প্রতিরোধের উদ্যোগ একেবারেই সীমিত।
বর্তমান ছাত্রনেতাদের চিত্তের চেয়ে বিত্তের খেয়াল বেশি। উনাদের বিলাসবহুল গাড়ি দরকার, আলিশান বাড়ি দরকার, ব্যংক ব্যালেন্স দরকার, প্রভাব প্রতিপত্তি দরকার, আবার দরকার ঠিকাদারের টাকার শতকরা হার, আর সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে সরকার, অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন মহল তথা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা।
ছাত্র রাজনীতির বিচ্যুতির জন্য অনেকেই সামরিক সরকারগুলোকে দায়ী করেন, নিঃসন্দেহে অনেকাংশ সে দায় তাদের রয়েছে। কারণ বিভিন্ন সময়ে সামরিক সরকারগুলো তাদের ক্ষমতাকে নিরুঙ্কুশ করতে দেশের মেধাবী সম্ভাবনাময় ছাত্রসমাজকে অর্থের পাশাপাশি যুক্ত করেছেন অস্ত্রের রাজনীতিতে। ফলে নিউটনের তৃত্বীয় সূত্র অনুসারে সেই ক্রিয়ার সমান কিংবা বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ অস্ত্রের বদলে ফুল দেয়নি, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ঢিলের বদলে ছুঁড়েছে পাটকেল।
সুতরাং প্রেক্ষাপটের দোহাই দিয়ে ছাত্ররাজনীতির পতন কিংবা পচনের দায় এড়ানো সামরিক সরকারগুলোর পক্ষে অনেকটাই দুঃসাধ্য। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, সেই সময়ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনে খুব একটা ছেদ পড়েনি, কেউ তেমন বাধ সাধেনি। তাই ভাটা পড়েনি নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়ায়। একসময় সেই নেতৃত্বই জাতীর ক্রান্তিকালে রেখেছে যথাযথ অবদান, যার প্রমাণ ৯০ এর গণ অভূত্থান। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আবহে ছাত্র রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে স্ব মহিমায় উদ্ভাসিত না হয়ে হয়েছে কলুষিত। কিন্তু কেন? বিদগ্ধজন আর বিশ্লেষকদের কাছে এই কেন;র উত্তর বহুবিধ। আমার কাছে মুষ্টিমেয়। প্রথমত ছাত্র সংগঠন গুলোর কাছে এখন কোন পলিটিক্যাল টাস্ক বা রাজনৈতিক কোন কাজ নেই। আমরা প্রায়শই ছাত্র রাজনীতির যে গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের কথা বলি সেই সময়ের নেতৃত্বের সামনে ছিলো সুপরিকল্পিত পথনকশা, মোটা দাগে যদি বলি ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯ এর গণঅভূত্থান, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ এমনকি ৯০ এর গণআন্দোলন প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্রদের সামনে ছিলো অভীষ্ট লক্ষ্য। তবে কি আজ সেই লক্ষ্যের প্রয়োজনীতা ফুরিয়ে গেছে। তবে কি আজ দেশে কোন সংকট নেই, কোন জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু নেই, অবশ্যই আছে।
খোদ সরকারি দল যেখানে দফায় দফায় বিভিন্ন ভিশন, রূপকল্প জাতীর সামনে উপস্থাপন করছে সেখানে ছাত্র সংগঠনগুলো যেন লক্ষ্যহীন, দিকভ্রান্ত। অপরিমেয় সম্ভাবনার তরুণ সমাজের তারুণ্য আজ অপচয়, অবক্ষয়ের পথে। কারণ মুরুব্বী সংগঠন বা মূল দল তাদের কোন যুগোপযোগী কর্মসূচি কিংবা দিক নির্দেশনা দিতে পারছে না, ফলে কাজের চেয়ে অকাজটাই হচ্ছে বেশি!
অন্তত বৃহত্তর ছাত্র সমাজের স্বার্থে কোন পদক্ষেপ নিতে এখন আর ছাত্র সংগঠন গুলোকে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। কেউ আছে নেত্রীর মুক্তি নিয়ে ব্যস্ত আবার কেউ নেত্রীর শক্তি পোক্ত করতে পরিশ্রান্ত। অথচ দেশের প্রায় প্রত্যেক কলেজে ভর্তি ফি বাড়ানো হয়েছে, বেড়েছে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা উপকরণের মূল্য, এই নিয়ে কারো যেন কান মাথাব্যথা নেই। আর যাদের কিছুটা মাথাব্যথা রয়েছে, সেই বাম ছাত্র সংগঠন গুলোর আবার নিজেদের মাথার সংখ্যা কম, পাশাপাশি কম তাদের কর্মকাণ্ডের প্রচার প্রচারণা। ফলে অব্যক্তই থেকে যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সমাজের প্রাণের আকাঙ্ক্ষা,আকুতি। সঙ্গত কারণেই বাড়ছে দুর্গতি। বলা হয়ে থাকে যে কোন সংগঠনের সঠিক বিকাশের জন্য তিনটি বিষয় প্রয়োজন আর তা হচ্ছে সুস্পষ্ট স্বপ্নের আগামী,কর্মমুখর বর্তমান, গৌরবময় অতীত।
আমাদের ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় অতীত আছে ঠিকই কিন্তু বলতে গেলে কোন ছাত্র সংগঠনেরই নেই আগামীর সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, ফলে সেই অর্থে জনস্বার্থে কোন এ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের নেই কোন তাগিদ। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এখনকার নেতৃত্ব নিজেদের আখের গোছাতেই যেন কর্মমুখর রেখেছেন তাদের চলমান বর্তমানকে। ফলে দুহাজার কোটি টাকা পাচারের দায় স্বিকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে হয় জেলার ছাত্রনেতাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রলীগ কর্মীকে সালাম দিতে দেরী করার অপরাধে কিল ঘুষি লাথি খেতে হয় নিরীহ অসহায় সাধারণ ছাত্রকে। সাংবাদিককে শুনতে হয় ছাত্রলীগ নেত্রীর অশ্রাব্য গালাগাল। পরিস্থিতি এতোটাই শোচনীয় যে, এখন আর সবক্ষেত্রে সংঘর্ষ, হাতাহাতি, লাঠালাঠি এমনকি গোলাগুলি করতেও প্রতিপক্ষের প্রয়োজন হয় না। বরং নিজেদের অর্ন্তদ্বন্দ্ব কিংবা দুপক্ষের বিরোধেই সম্পন্ন হয় সেই আয়োজন। ছোট মাঝারি বড় সকল নেতৃত্বের ভেতরেই যেন কৃত্রিম আভিজাত্য শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রবল প্রবণতা।
ছাত্ররাজনীতির বেহাল দশার আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে, মুল রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের অযাচিত নগ্ন হস্তক্ষেপ। অতীতে ছাত্র সংগঠনগুলোর স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল। তারা দলীয় সর্বোচ্চ নেতার আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতো ঠিকই কিন্তু পরিচালিত হতো নিজেদের নেতৃত্ব দ্বারা। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (মেয়াদকাল ১৯৭২-৭৩) শেখ শহীদুল ইসলামের আলাপচারিতা উল্লেখ করতে চাই। অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলছেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছি কিন্তু চলেছি নিজেদের পথেই। বঙ্গবন্ধু কখনই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেননি, এটা তিনি ছাত্রদের উপরই ছেড়ে দিতেন।
অথচ বর্তমানে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাকামী দলের ভেতর নানা বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও নিজ ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহনের বিষয়ে উভয় দলের অবস্থান প্রায় একই! এখানে মূলদল কিংবা অঙ্গসংগঠনের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থাকছেই, থাকবেই এটাই যেন অলিখিত নিয়ম। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতিতে যে সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা প্রতিভার উন্মেষ ঘটার কথা ছিল তা হয়নি, দিনে দিনে বিচ্যুতি মাথা চাড়া দিয়েছে, গড়ে উঠছে স্বার্থপর সুবিদাবাদী শ্রেণি।
আসলে ছাত্র শব্দটি এসেছে “ছত্র” ধাতু থেকে। আর ছত্র যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “ছাতা”। ছাতা যেমন রোদ বৃষ্টি থেকে মানুষকে রক্ষা করে ঠিক তেমনি ছাত্র সমাজেরও জাতিকে বিভিন্ন ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আগলে রাখতে কিংবা পথ বাতলে দিতে ভূমিকা রাখবার কথা। সেজন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রয়োজন আপন আলোয় পথ দেখা। তবেই হয়তো উগ্রতার বদলে আমরা পাবো উদারতা, শালীনতা আর সহনশীলতার ছাত্র রাজনীতি। ক্রমান্বয়ে যা ছড়িয়ে পড়বে জাতীয় রাজনীতিতে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস