ধর্মান্তরিত ব্যক্তির উত্তরাধিকার ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা
আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ১২ বছর আগে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে। সে বিবাহিত; সন্তানাদি আছে। তাদেরকে নিয়ে সে আলাদা থাকে। লোকটির বাবা বেঁচে নেই; মা ও অবিবাহিত ছোটবোন আছেন। ধর্মান্তরের পর তাদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন। মা, মেয়ে কোনমতে দিন চালায়। শ্রীঘ্রই তার ছোট বোনের বিয়ে হবে। প্রশ্ন হলো-
★ ঐ পরিবারে মেয়েটির বিয়ের পর মায়ের কাছে যা সম্পত্তি থাকবে তার উত্তরাধিকারী কে হবেন?
★ ধর্মান্তরিত পুত্র কোনভাবে সম্পত্তি দাবি করতে পারেন কি-না?
★ মায়ের মৃত্যুর পর সম্পত্তিগুলো মেয়েটি যেন পায়, তার জন্য ঐ পরিবারের করণীয় কি?
রাজীব শর্মা নামে এক ভদ্রলোক হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের ফেসবুক গ্রুপে উপরোক্ত বিষয়টি জানতে চেয়েছেন। জবাবে ড. সনজিৎ মজুমদার নামে একজন মতামত দিয়েছেন:
“বাবার মৃত্যুর আগে ধর্মান্তরিত হলে ছেলে সম্পত্তির ভাগ পাবে না। কারণ তার পিন্ডদানের অধিকার থাকে না। পিন্ডদানের ক্রমঅধিকারী ব্যক্তিরাই উত্তরাধিকারী হয়। বাংলাদেশে ইহাই আইন।
ছেলে না পাইলে মৃতের স্ত্রী ও মেয়ে ভোগদখল করতে পারবে। কিন্তু বিক্রি করতে পারবে না। তবে মেয়ের বিয়ে কিংবা সাংসারিক খরচের জন্য কোর্টের অনুমতি নিয়ে কিছু অংশ বিক্রি করার অধিকার পাবে। মেয়ের ছেলে অর্থাৎ মৃতের নাতি হলে সে বা তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। উল্লেখ্য, ছেলে পিতার মৃত্যুর আগে ধর্মান্তরিত হয়েছে মর্মে প্রমাণাদি প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে।”
রাজীব শর্মা: “তাদের বাবা মারা যায় তারা ছোট থাকা অবস্থায় (২৭ বছর আগে)। ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে সে পিতার মৃত্যুতে পিন্ডদান করেছে। এরপর ধর্মান্তরিত। সে মা বোন দেখে না। মা তবুও তার সাথে ফোনালাপ করে। এখন ভাবছি, বোনকে বিয়ে দেওয়ার পর মায়ের কেনা সম্পত্তি দখল করবে কি-না! আরেকটি বিষয়, মা কি চাইলে মেয়ের নামে সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে দিতে পারবে?”
ড. সনজিৎ মজুমদার: যেহেতু সে পিন্ড দান করেছে তাই সে সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও হয়েছে। এখন ধর্মান্তরিত বিষয়টি তার স্বাধীনতা। ইহা উত্তরাধিকার পেতে সমস্যা নয়। তবে তার মা ও বোনের ভরণপোষণ এবং বোনের বিয়ের খরচ তাকেই বহন করতে হবে। ইহাই আইন। তবে মায়ের সম্পত্তি বা কেনা সম্পত্তির ভাগ ছেলে পাবে না। কারণ সে মায়ের পিন্ডদানের অধিকার হারিয়েছে।”
এই পর্যায়ে আমি মতামত দিয়েছি: “ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে পিতার পিন্ডদান করলেও সে এখন ব্রাত্য। হিন্দু আইনে ব্রাত্য বা পতিত ব্যক্তি উত্তরাধিকার পায় না। তাছাড়া তিনি এখন মুসলিম পারিবারিক আইনের আওতাধীন। একারণে তিনি হিন্দু পারিবারিক আইনের আওতায় সম্পত্তির, ঐতিহ্যের বা কৃষ্টির ভাগিদার নন। তিনি শুধুমাত্র তার সোপার্জিত সম্পদের মালিক। আইনগতভাবে তার পিতার সম্পত্তির জীবনসত্ত্ব এখন তার মায়ের এবং বোনের। বোনের পুত্র সন্তান হলে সেই সন্তান সম্পত্তির পূর্ণ অধিকার পাবে।”
হিন্দু আইন সংস্কারের লক্ষে কাজ শুরু করার পর থেকে এধরনের নানা রকমের জটিলতা নিয়ে অনেকেই আমার কাছে আসছেন। এখানে আইনগত ব্যাখ্যায় অনেক জটিলতা আছে। কারণ হিন্দু আইন আনুপূর্বিক সংবিধিবদ্ধ (codified) নয়। এগুলো বহুলাংশে ধর্মের নামে প্রথা ভিত্তিক আইন। জটিলতা নিরসনের জন্য আইনগুলো কোডিফাই করা দরকার।
দেশে সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার দিয়ে অভিন্ন পারিবারিক আইন করা হয়নি। এখানে মুসলমানদের জন্য মুসলিম পারিবারিক আইন; হিন্দু, বৌদ্ধ ও বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর জন্য হিন্দু আইন ও প্রথাভিত্তিক আইন এবং খ্রিষ্টানদের জন্য আলাদা আইন চালু আছে। এই ব্যবস্থায় কেউ ধর্মান্তরিত হলে সেই ব্যক্তি কোন পারিবারিক আইনের আওতায় পরবে, তা নির্ধারণ করা জটিল।
তবে বাস্তবতা হল, কেউ মুসলমান থেকে খ্রিস্টান, হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার পাওয়া তার জন্য কঠিন। কিন্তু হিন্দু বা বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হয়ে গেলে তার গায়ের জোর আরও বাড়ে। দেশে গায়ের জোরের অনেকরকম প্রয়োগ আছে। বিশেষ করে যখন দখল স্বত্ব একটি স্বীকৃত বিষয়। দখল যার, সম্পত্তির উপর অধিকার তার। আদালতে মামলা মোকদ্দমা করে দখল উচ্ছেদ করা? সেটা দুর্বল এবং গরীবের জন্য নয়। শত বছরেও অপেক্ষার শেষ হয় না। বরং মামলা করে আরও নি:শেষ হওয়ার সুযোগ থাকে।
কেউ ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তি কেন পাবে না? এর এক নম্বর কারণ হল, ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তি পাওয়ার কোনো আইন নেই। ধর্মান্তরিত হলেও সম্পত্তি পাবে – ইংরেজরা এই বিধান চালু করে ১৮৫০ সালে Cast Disabilities Removal Act নামে একটি আইন করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদে “প্রচলিত আইনের কার্যকরতা অব্যাহত থাকিবে” মর্মে ঘোষণা দেওয়া হয়। সংবিধানের সেই ঘোষণার আলোকে ১৯৭৩ সালে Bangladesh Laws (Revision and Declaration) act প্রণয়ন করা হয়– যে আইনটির আওতায় প্রচলিত বিভিন্ন আইন আত্তীকরণ করা হয়েছিল। তবে ইংরেজদের বানানো Cast Disabilities Removal Act-1850 গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ধর্মান্তরিত হলেও পৈত্রিক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পাওয়ার কোনো বিধান এখন নেই।
সঙ্গে একথাও বলতে হবে, ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার থাকবে না– এই মর্মেও বাংলাদেশের সংসদে কোনো কোডিফাইড আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এই জায়গায় ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়টি আলাদা আলাদা প্রথাভিত্তিক পারিবারিক আইনের উপর ন্যস্ত হয়ে আছে। ফলে বিষয় ও ক্ষেত্রভিত্তিক অস্পষ্টতা আছে এবং জটিলতা তৈরি হচ্ছে। তাই ধর্মান্তরিত ব্যক্তির উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো সুবিন্যস্ত, সুনির্ধারিত ও সুস্পষ্ট করে আইন প্রণয়ন করা দরকার।
এক্ষেত্রে তিনটি দিক বিবেচ্য:
১. প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়ার অধিকার
২. তিনি যে পরিবারে জন্ম নিয়েছেন সেই পরিবার ও সমাজের প্রতি তার দায়দায়িত্ব এবং
৩. ছেড়ে আসা পরিবার ও সমাজে তার অধিকার।
সঙ্গে আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। তা হল, রাষ্ট্র বা সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দেবে কিনা? আইনের দ্বারা ধর্মান্তর উৎসাহিত করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেবে কিনা? কোনো পরিবার থেকে একজন ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হলে সেই পরিবারের যে অবমাননা, বিচ্ছেদ, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি সাধিত হয় – সেটি বিবেচনায় নেবে কিনা। একটি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ধর্মের সুরক্ষা দেবে কিনা? বিষয়টি সংখ্যালঘুদের জন্য বাঁচামরার প্রশ্ন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতিসত্ত্বার জন্য সংহতি ও সহাবস্থান বজায় রাখার প্রশ্ন।
এ পর্যায়ে আরেকটি কাহিনী বলি। প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। রংপুরে আমারই নিকটাত্মীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের পনের বছরের একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এক প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের ছেলে। অপহরণের মামলা হয়। নিখোঁজ অবস্থায় রংপুরের “যুগের আলো” পত্রিকায় আসামীদের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়। তাতে বলা হয়, মেয়েটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে ধর্মান্তরিত হয়ে ঐ মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করেছে। বিষয়টি নিয়ে ঐ এলাকার হিন্দু সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং বড় রকমের প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, মিছিল, সমাবেশ, ঘেরাওসহ প্রশাসনকে সবধরনের গণতান্ত্রিক চাপ দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করেনি। একটি হিন্দু মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্মান্তরিত করলে “সওয়াব হয়”— এরকম বিশ্বাস শুধু সাধারণ মানুষের নয়; দায়িত্বশীল পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটকেও এই বিশ্বাস দ্বারা চালিত হতে দেখেছি। ঘটনার প্রায় এক বছর পর মেয়েটিকেসহ আসামীরা আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। মেয়েটি তখন অন্তঃসত্ত্বা। জীবনের রুঢ় বাস্তবতার কাছে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
দেশে এরকম ধর্মান্তরের ঘটনা অনেক এবং দিন দিন বাড়ছে – যেগুলি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মনে প্রতিনিয়ত রেখাপাত করছে। যে কোনো সম্প্রদায় তাদের জীবন এবং সম্পত্তির উপর হামলার চেয়েও নারীর উপর হামলাকে মারাত্মক মনে করে। মহাভারতে রাজসভায় দ্রৌপদির অপমানের পরিণতিতে কুরুক্ষেত্রের মহারণ ও ধ্বংসলীলা হয়েছিল। গ্রিক পুরাণের হেলেনের জন্য ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল। সীতা অপহরণ নিয়ে রামায়নে লেখা হয়েছে মহাযুদ্ধের কাহিনী। “রাম-রাবণের যুদ্ধ” যাত্রাপালার শেষ দিকে রাবণের একটি ডায়লগ মনে পরে। তিনি আক্ষেপ করছেন,
“এক লক্ষ পুত্র আমার সোয়ালক্ষ নাতী
কেহ না রহিল আর বংশে দিতে বাতি।”
নারীর সম্ভ্রম তথা পারিবারিক মর্যাদার উপর আঘাত আসলে মানুষ যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠে; সবটুকু সামর্থ দিয়ে লড়তে চায়। গণমানুষের এই সংবেদনশীলতা বুঝতে হবে। কিন্তু সংখ্যালঘুর এই সংবেদন ও আর্তচিৎকার কেউ কি শুনছে? দেশে প্রবল ইসলাম অনুভূতির তোড়ে হিন্দু নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা এবং তাদের ধর্মের উপর ক্রমাগত আঘাতের বিষয়টি সবসময় উপেক্ষিত হচ্ছে। অপহরণের মামলাগুলোতে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অবিচার করছে। অপহরণকারীদের সুযোগ দিচ্ছে। এর পরিণতি রাষ্ট্র এবং সামাজিক সংহতির জন্য শুভ নয়। সুতরাং ধর্মান্তরের প্রশ্নে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বাকে বিশেষ সংরক্ষিত অধিকার দিতে হবে। ধর্মান্তরিত নারী বা পুরুষ যাতে তাদের ফেলে আসা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তিতে হাত দিতে না পারে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এসব কারণেই সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি – যে বিষয়ে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের সকল সম্প্রদায়ের সকল সংগঠন আজ ঐক্যবদ্ধ। এখন সবগুলো সংগঠন মিলে প্রস্তাবনাগুলো চুড়ান্ত করে এই আইনের একটি খসড়া সরকারের কাছে জমা দেওয়া দরকার। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের অনেকগুলো দিক আছে। তার মধ্যে শুধু ধর্মান্তরের প্রশ্নে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা প্রদানের বিষয়টি আপাতত আলোচনা করছি।
ধর্মান্তরের সঙ্গে সম্পত্তির অধিকার ছাড়াও আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক। সেটি হল বিবাহ – নরনারীর নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী নির্বাচন করে একত্রে বসবাসের অধিকার। প্রেম মানেনা রাজা-প্রজা, প্রেম করেনা জাতির বিচার– একথা সত্য। বিয়ের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। তবে আন্তঃধর্ম বিয়ে সংখ্যালঘুর জন্য সুখকর নয়।
ভিন্ন ধর্মের কোনো নর-নারী বিয়ের পর বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে তাদের নিজেদের ঐতিহ্যগত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে নিরাপদে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবে – এমন পরিবেশ নেই। এখানে ধর্মের নামে জোর জুলুম আছে। প্রলোভন দিয়ে হোক বা গায়ের জোরে হোক, সংখ্যালঘুর ধর্ম কেড়ে নেওয়া বা তাদের উপর ভিন্নধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে। এটা যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্য বিশেষ বিধান করা দরকার।
ধর্মান্তরের দাপ্তরিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিশেষ আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ করে কমপক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমমানের বিচারিক আদালতে পূর্ণাঙ্গ শুনানী ও রায় গ্রহণের বিধান চালু করা দরকার। কেউ ধর্মান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করলে কমপক্ষে আদালতের মাধ্যমে পরিবারের কাছে তিন মাস আগে নোটিশ দেবে।
আদালতে প্রথম শুনানীর পর ব্যক্তির নিজস্ব মতিভ্রম বা অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য আদালত তাঁকে অন্তত: ৬ মাস বিবেচনার সময় দেবে। শুনানীর সময় ব্যক্তির পিতামাতা বা ঘনিষ্ট তিন জন আত্মীয় এবং একজন সংখ্যালঘু সমাজ প্রতিনিধির আবশ্যক উপস্থিতি এবং আবেদনকারী ব্যক্তির নিয়োগকৃত আইনজীবী ছাড়া আদালত কক্ষে অন্যদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ থাকবে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে হলে ১৮ বছরেই সাবালকত্ব নির্ধারণের সুযোগ সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিশেষ আইনের দ্বারা রহিত করে ২১ বছরে নির্ধারণ করা উচিত। এরকম বিয়ের ক্ষেত্রে আদালতের সামনে পিতামাতা ও সংশ্লিষ্ট সমাজের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে লিখিত সম্মতি গ্রহণের বিধান আবশ্যক। অপহরণের মামলার ক্ষেত্রে পলাতক ব্যক্তিকে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ বাধ্যতামূলক, নইলে দ্রুত গতিতে আসামীর সম্পত্তি ক্রোকসহ বিশেষ দন্ডবিধান এবং ঘোষিত বিবাহ বাতিল বলে বিবেচিত হওয়া দরকার। পলাতকদের আটকের পর ২১ বছরের নিচে যে কোনও ছেলে বা মেয়েকে তার পিতা-মাতার জিম্মায় দেওয়ার বিধান দরকার। এই ক্ষেত্রে আসামীর পরিবার, পুলিশ এবং মেজিস্ট্রেটের দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সম্মতির বয়স ১৮ বছরের পরিবর্তে ২১ বছর করার যে প্রস্তাবনা আমি দিচ্ছি তা নতুন নয়। এই আইন আগে থেকেই আছে, যা নতুন সুরক্ষা আইনে কেবল সুস্পষ্ট করা দরকার। ইংরেজ আমলে প্রণীত Special Marriage Act 1872 অনুযায়ী যে কোনও ধর্মের নরনারী বিশেষ ব্যবস্থায় বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে শুধু ১৮ বছর হলেই চলে না। বয়স ২১ বছরের কম হলে পিতা-মাতার সম্মতি লাগে। ঐ আইনের একটি সীমাবদ্ধতা হল, এ ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে নর-নারীকে ধর্মত্যাগের ঘোষণা দিতে হয়। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রেখে এই আইনের আওতায় বিয়ে করতে পারে না।
মূল আইনটিতে ধর্মত্যাগের বাধ্যবাদকতা সুস্পষ্টভাবে না থাকলেও ১৯৪৬ সালের “মুস্তাফিজুর রহমান বনাম রিনা খান” মামলার রায়ে আদালতের দেওয়া ব্যাখ্যার (১৮ ডিএলআর ৫০৯) কারণে এ ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে এফিডেভিট করে নিজেদের ধর্মত্যাগী ও নাস্তিক হিসেবে ঘোষণা দিতে হয়। এই জায়গায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে সময়ের চাহিদায় আইনটির আধুনিকায়ন করা দরকার। সঙ্গে প্রচলিত পারিবারিক আইন সংশোধন করে নারীকে সমান উত্তরাধিকার ও সমান মর্যাদা দিয়ে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করা দরকার। হিন্দুদের জন্য এটা বেশি জরুরি।
সংখ্যালঘু নিপীড়ন ঠেকাতে এবং সুরক্ষার প্রয়োজনে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা আমাদের দেশের জন্য অতীব গরুত্বপূর্ণ। এই সুরক্ষা পাওয়া সংখ্যালঘুর অধিকার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। এই আইন প্রণয়নে বিরোধিতা করার কারও কোনো অবকাশ নেই। কারণ মাইনরিটি রাইটস বা সংখ্যালঘু অধিকার জাতিসংঘ স্বীকৃত মানবাধিকার। এ বিষয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি বা সুইডেনের মতো দেশে গণতন্ত্রের সংকট নেই। সে সব দেশে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পূজা অনুষ্ঠানে দলবদ্ধভাবে হামলা করা হবে ভাবা যায় না।
রাতের আঁধারে নিরীহ মানুষের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে কল্পনা করা যায় না। কোনো মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্মান্তরিত করা হবে ভাবা যায় না। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নাস্তিক বা বিধর্মীর কল্লা চাই দাবি করে মিছিল করবে – একথা কল্পনা করা যায় না। উন্নত দেশগুলোতে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের ঘাটতি প্রকট নয়। তবুও সেসব দেশে সংখ্যালঘুদের বিশেষ অধিকার আইনের দ্বারা স্বীকৃত।
জাতিগতভাবে (ethnic and racial), ভাষাগত ক্ষেত্রে, লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে এবং ধর্মীয়ভাবে যে জনগোষ্ঠী সংখ্যায় কম তারা সংখালঘু। এই সংখ্যালঘু একটি বাস্তব সত্তা এবং বাংলাদেশের জন্য তাদের বাস্তবতা ভয়ংকর। এই দেশে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী। সংখ্যালঘুদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ জন্য বিশেষ আইন করার সুযোগের বিধান বাংলাদেশের সংবিধানে আছে।
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের ন্যায্যতার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও একমত। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ৩.২৯ নম্বর পয়েন্টে “ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়” সংক্রান্ত অঙ্গিকারনামার দ্বিতীয়টি হল, “জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রনয়ণ করা হবে।” এটি আওয়ামী লীগ তথা জননেত্রী শেখ হাসিনার ওয়াদা। সরকারের মেয়াদ এখন শেষের দিকে চলে এসেছে। দ্রুত এই প্রতিশ্রুতি পূরণে মনোনিবেশ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক: পুলক ঘটক, সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস