বিদেশ থেকে আসা দেশি সন্ত্রাসী


প্রকাশিত: ০৩:৩৭ এএম, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

দুটি উদ্বেগজনক খবর গেল সপ্তাহে সংবেদনশীল মানুষকে নাড়া দিয়েছে। পাকিস্তানে পেশোয়ারে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন জঙ্গি হামলার খবরটি এলো, তখন একই সময় জানা গেলো জঙ্গিতৎপরতার অভিযোগে ২৬ বাংলাদেশি নাগরিককে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে পাঠানো হয়েছে। সাথে আরো একটি ভয়ানক খবর ছিল  বৃটেনে যাওয়া এক বাংলাদেশের তরুণের জঙ্গি হয়ে উঠার পরিণতি। বৃটেনে গিয়ে উগ্রবাদি সশস্ত্র সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেটে জড়িয়েছিলেন সিরিয়ায় বিমান হামলায় নিহত বাংলাদেশের সাইফুল হক (সুজন)।) তরুণ এই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্যোক্তা কেবল নিজেই আইএসে যোগ দেননি, সঙ্গে নিয়েছেন স্ত্রী ও সন্তানদের। সঙ্গে বাবা, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই মতবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়ে বাবা-ভাইয়েরা কারাগারে। বড় ভাই আতাউল হক (সবুজ) স্পেনে আত্মগোপন করেছেন। এখন নিকটাত্মীয়রা উদ্বিগ্ন সাইফুলের স্ত্রী সায়মা আক্তার (মুক্তা) ও তাঁর তিন সন্তান নিয়ে। সায়মা সন্তানদের নিয়ে সিরিয়ায় আছেন বলে ধারণা আত্মীয়দের।

আলোচনায় স্বভাবতই বেশি ছিল সিঙ্গাপুরে ২৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে নিয়ে। এরা আটক হয়েছিলেন দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে। সিঙ্গাপুরের গোয়েন্দারা বলছেন গ্রেপ্তার হওয়া ২৬ জন বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের কথা ভাবছিল। তারা বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে টাকাও পাঠিয়েছে। এসব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানোর এক মাসের বেশি সময় পর গত বুধবার তাঁদের নাম ও ছবি সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশের নাগরিককে গ্রেপ্তার করে সিঙ্গাপুর পুলিশ। তাদের মধ্যে ২৬ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। বাকি একজন সিঙ্গাপুরের কারাগারে আছে।  সে ২৬ জনের দলে ছিল না, তবে উগ্র মতাদর্শের দীক্ষা নেওয়ার পথে ছিল এবং একজন উগ্রপন্থী ধর্মগুরুর সহযোগী ছিল।

আমাদের জন্য ভয়ানক উদ্বেগের খবর এটি। বিদেশে গিয়ে শ্রমজীবী এই মানুষগুলো যদি এমন সন্ত্রাসী হয়ে উঠে, তবে এদেশের ভবিষ্যত নিয়ে বড় ভাবনা আছে। তার চেয়েও বেশি আছে, আমাদের গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় এরা যে বীজ রোপন করে চলেছে তা নিয়ে।  

কেমন করে এ পথে যায় বা যাচ্ছে এরা? তথাকথিত বয়ান, ইসলামিক পাঠচক্র, ওয়াজ বা তাফসিরের নামে এদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা এখন বিদেশে বসবাসরত আমাদের সহজ সরল  মানুষকে টানছে মগজ ধোলাইয়ের জন্য। সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো ওই ২৬ জন সম্পর্কেও একই তথ্য পাওয়া গেলো। এরা উগ্র মতাদর্শী সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠীর পাঠচক্রে যুক্ত ছিলো। তারা সপ্তাহে একবার মিলিত হয়ে সশস্ত্র জিহাদ নিয়ে আলোচনা করতো। বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের কথা ভাবতো। ওই বাংলাদেশিদের কাছে জিহাদি বই, ভিডিও এমনকি সন্ত্রাসীদের শিবিরে শিশুদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ভিডিও পাওয়া গেছে। কয়েকজন সদস্যের কাছে বিভিন্ন উপায়ে গুপ্তহত্যা চালানোর নির্দেশনারও ছবি পাওয়া গেছে।
এটুকু হলেও যতটা চিন্তার বিষয়, তার চেয়ে আরো ভয়ংকর খবর যেটি উন্মোচিত তা আরো উদ্বেগের। এরা নিঃশব্দ খুনের কৌশল শিখছিল। ঠাণ্ডা মাথায় নিখুঁত দক্ষতায় মানুষ হত্যার ভাবনায় ছিল এরা। এবং আমরা দেখেছি কি নিঁখুত দক্ষতায় ঢাকায় একটি মার্কেটে নিঃশব্দে প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হয়েছে।

এখন থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক, শিক্ষার্থী, এমনকি চিকিৎসার জন্য যারা  সিঙ্গাপুর যায় তারাও কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকবে। জনশক্তি রপ্তানিতে এই ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম এই খাত এখন বড় ঝুঁকির মধ্যে। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হবে আশা করছি। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সময়, এসব কর্মীকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়ার রেওয়াজ আছে। কাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, আচার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, কিন্তু মনে হচ্ছে সিলেবাসে নতুন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের মগজে ধারণা দিতে হবে, বিদেশে গিয়ে এসব মাহফিলে যাওয়া কতটা ঝুঁকির। নিজের ধর্ম নিজের মতো করে পালন করা আর কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পালন করা এক নয়। তাফসিরের নামে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নোংরামী শোনা, বা অন্য কারো জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনার মধ্যে কোনো সওয়াব নেই, আছে সন্ত্রাসী হয়ে উঠার ঝুঁকি। যেসব দেশে আমাদের মানুষগুলো যাচ্ছে সেখানে পাকিস্তানি, আফ্রিকান, পশ্চিম এশিয়ার নাগরিকদের সাথে উঠাবসা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা এদের বুঝিয়ে দিতে হবে দেশ ছাড়ার আগেই। সজাগ থাকা জরুরি আমাদের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোকেও। বেশি বেশি রেমিটেন্সের সন্তুষ্টি আমাদের থাকবে না যদি এরা টাকা পাঠানোর পাশাপাশি বিদেশে সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসি মতবাদ প্রচার করতে থাকে। তাই প্রয়োজনে দূতাবাস কর্মকর্তারা বাংলাদেশ নাগরিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বা বৈঠকের আয়োজন করবেন। প্রয়োজন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা।             

তেমনি ভাবে পড়াশোনা বা কাজের জন্য যারা ইয়োরোপ বা পশ্চিমা দেশে যাচ্ছে তাদের অনেকেই সাইফুল হয়ে উঠছে। এমনিতেই খবর যা পাচ্ছি তা ভয়ানক। পশ্চিমা উন্নত গণতান্ত্রিক উদার পরিবেশে থেকেও অনেক বাংলাদেশি নাগরিক গোড়া মৌলবাদি হয়ে পড়ছে। এদের অনেকের সন্তানেরা ইংরেজি জানে, সেই দেশের ভাষা জানে, আর জানে আরবী, কিন্তু বাংলা জানে না।

জার্মানি মুসলমান শরণাথীরা ইংরেজী নববর্ষ পালনের দিন কোলনে নারীদের নিগ্রহ করার পর নড়ে চড়ে বসেছে মার্কেল সরকার। অনেককে স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু  সবাইকে অবাক করে দিয়ে নারী ধর্ষক আর নির্যাতনকারীদের পক্ষ নিয়েছে কোলনের এক মসজিদের ইমাম। এই লোক বলছে,  নারী নিগৃহীত হয়েছে কারণ তারা সংক্ষিপ্ত  পোশাক পড়েছিল, গায়ে সুগন্ধি মেখেছিল যা পুরুষকে উৎসাহিত করছে নির্যাতিত করতে। একথা বলছে জার্মানি থাকা এক হুজুর,  কোনো হাটহাজারির হুজির নয়। বুঝতে পারা যায় কতটা ভয়ংকর সহিংস, সভ্যতা বিরোধী গোড়ামী জেঁকে বসেছে পশ্চিমা সমাজে থাকা মুসলিম সমাজে।

বাংলাদেশ এখনো এমন দেশ যেখানে খুব সহজেই ধর্ম ব্যবসায়ীরা চাইলেই ধর্মের নামে হাজারো তরুণকে উগ্রপন্থায় সহিংস করে তুলতে পারে।  মাদ্রাসা ছাত্র, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণদেরও ধর্মের দোহাই দিয়ে ইসলাম গেল গেল রব তুলে ভাতৃঘাতী পথে নামিয়ে দিতে পারে। হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৫ মে আমাদের সেটা জানিয়ে দিয়েছে।

এই যখন বাস্তবতা তখন বিদেশ থেকে মনোবল চাঙ্গা করা এই নব্য জঙ্গিরা এক নতুন উদ্বেগ। সমাজের কোনো  উপলব্ধি আছে কী?

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।