পোশাক নিয়ে সমস্যা কোথায়?
ঘটনাটা ভাইরাল হয়েছে। নিজের চোখে যখন ভিডিও দেখলাম তখন মেজাজটা যে কী পরিমাণ খারাপ হলো! বলছি নরসিংদীর ঘটনাটির কথা।
একটি তরুণী মেয়েকে একজন নারী ও কয়েকটি পুরুষ বিশ্রীভাষায় গালাগালি করছে এবং তাকে রীতিমতো শারীরিক আক্রমণ করছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে যতটুকু জানা যায় যে, এক তরুণী তার বন্ধুদের সঙ্গে নরসিংদী স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় অপর এক নারী এসে তাকে বলে এই পোশাক পরেছ কেন? বলে তাকে গালাগালি করে। তরুণীটি জানতে চায় সমস্যা কোথায়। এইভাবে তর্ক বিতর্ক এবং তরুণীকে শারীরিক লাঞ্ছনা এবং ভয়াবহভাবে গালাগালি করা হয়। এইবার আসি পোশাকের প্রসঙ্গে। তরুণীর পরনে ছিল স্লিভলেস টপস ও জিন্স। আক্রমণকারী নারীর পরনে ছিল বোরকা ও হিজাব।
এই ঘটনায় কয়েকটি গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম দেখে মেজাজটা আরেকটু খারাপ হয়েছে। ‘আপত্তিকর পোশাক পরায়’ তরুণীকে লাঞ্ছনার কথা বলা হয়েছে সেসব রিপোর্টে। আমার কাছে ‘আপত্তিকর পোশাক’ শব্দের ব্যবহারটিই আপত্তিকর বলে মনে হয়েছে। কারণ যখন একটি অপরাধ ঘটে তখন এ ধরনের বিশেষণের ফলে অপরাধটিকে এক ধরনের জাস্টিফাই করা বা কারণ দর্শানো গোছের চেহারা দেয়া হয়। যেমন ভাত রাঁধতে দেরি করায় স্ত্রীকে হত্যা, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তরুণীকে হত্যা বা নির্যাতন ইত্যাদি।
প্রথমত অপরাধের কোন জাস্টিফিকেশন করার প্রয়োজন নেই। অপরাধটিই শিরোনাম। দ্বিতীয়ত, ‘আপত্তিকর পোশাক’ শব্দটি যথেষ্ট আপত্তিকর। কারণ কোনটা আপত্তিকর পোশাক তা কে নির্ধারণ করেছে বা করবে? স্লিভলেস যে ‘আপত্তিকর’ সেটা কোথায় লেখা আছে বা কোন আইনে আছে? ‘আপত্তি’ই বা কার? আপত্তি করার অধিকারীই বা কে?
সোজা কথায় বলি। পোশাক একজন মানুষের ব্যক্তিগত চয়েজ। একজন মানুষ শার্ট পরবে, পাঞ্জাবি পরবে, আলখাল্লা পরবে, শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, স্কার্ট টপস, জিন্স, স্লিভলেস, বোরকা, হিজাব, হ্যাট, টুপি বা তার ইচ্ছামতো পোশাক পরবে। এটাই ব্যক্তি স্বাধীনতা। আমার পোশাক আপনার পছন্দ নাও হতে পারে, আপনার পোশাক আমার নাও পছন্দ হতে পারে। কিন্তু আমি আপনাকে পোশাকের জন্য অপমান বা হেনস্তা বা হয়রানি করার অধিকার রাখি না, আপনিও তা রাখেন না।
কিছুদিন আগে ঢাকার এক বাসযাত্রী মেয়েকেও অন্য এক নারী ভীষণভাবে গালাগাল ও হেনস্তা করেছিল। সেখানেও একই বিষয় ছিল। তরুণীর পরণে ছিল টিশার্ট ও জিন্স। অন্যদিকে আক্রমণাত্মক নারীর পরনে ছিল হিজাব ও বোরকা।
আমি নিজে মনে করি হিজাব বা বোরকা যেমন ‘পারসোনাল চয়েজ’ তেমনি স্লিভলেস, বা জিন্স, টিশার্টও ‘পারসোনাল চয়েজ’। একটি মানলে, অন্যটিও মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশের অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠি তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন। সেটাও মানতে হবে। কিছুদিন আগে একজন নারী অধ্যাপককে টিপ পরার জন্য হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে।
নরসিংদীতে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমাদের সমাজে বৈচিত্র্য ও অন্য মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং অন্য মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়কে সম্মান করার প্রবণতা দিন দিন যেন কমছে। এটা অসহিষ্ণু সমাজের উপসর্গ।
দরকার হলো এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এবং অপরাধীর কড়া শাস্তি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আর অন্য কেউ এমনটি করার সাহস পাবে না। এটা যে কোন অপরাধের বেলাতেই প্রযোজ্য।
যে নারী আক্রমণাত্মক কথাবার্তা ও আচরণ করছিল তার ভাব দেখে মনে হচ্ছিল সে বিরাট একটি বাহাদুরির কাজ করছে। কিন্তু অন্যকে হয়রানি করা যে কোনভাবেই বাহাদুরি নয় বরং ঘৃণিত অপরাধ সেটা তাকে বুঝানোর জন্য দরকার কঠোর শাস্তি প্রদান। তার শাস্তি হলেই আর কেউ এমন করার কথা চিন্তা করবে না। বিচার ও শাস্তির পাশাপাশি চাই গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক লেখা, প্রচার ও প্রচারণা।
অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ যে বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ সেকথা শিশু বয়স থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। একটি সমাজ যত সভ্য ও সুশিক্ষিত হয় সেখানে ব্যক্তি অধিকার ততো বেশি সুরক্ষিত থাকে। কেবল বড় বড় অবকাঠামো আর রেমিটেন্সই উন্নয়ন নয়। দরকার মানসিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নও।
এসব বর্বর অপরাধীদের শাস্তি বিধান এবং মানুষের ব্যক্তি অধিকারকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র ও সমাজকেও প্রমাণ করতে হবে যে তারা সভ্য ও উন্নত।
নরসিংদীর ঘটনাটির অবিলম্বে সুষ্ঠু তদন্ত, অপরাধীকে শনাক্তকরণ এবং তার শাস্তি বিধান দাবি করছি। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে সেটি নিশ্চিত করার এটিই একমাত্র পথ।
লেখক: কবি, সাংবাদিক।
এইচআর