ঈদ মেয়েটির কাছে কী রঙ নিয়ে হাজির হবে?
লবণ বেগম বেঁকে বসল। টাকার খাম সামনে রেখে মাথা নেড়ে বলল-
: আমি যাব না।
ছেলেরা কাপড়চোপড় পরে তৈরি। মায়ের কথা শুনে তারা চোখ বড় করে আমার দিকে তাকাল। আমি অসহায়ের মতো একবার লবণ বেগমের দিকে, একবার ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মিনমিন স্বরে বললাম-
: কেন, সমস্যা কী!
ধপাস করে সোফায় বসে লবণ বেগম বলল-
: প্রচুর সমস্যা। এই টাকা দিয়া বাজারের ব-ও হবে না।
: যতটুকু হয়, তাই করবা।
: আমার পক্ষে সম্ভব না। ছেলেদের লইয়া তুমি মার্কেটে যাও।
ট্রেনের টিকিট কেনার জন্য আমার কমলাপুর যাওয়ার কথা। সে প্রসঙ্গ সামনে এনে বললাম-
: আমি মার্কেটে গেলে ট্রেনের টিকিট কাটতে যাবে কে?
লবণ বেগম অর্ন্তভেদি দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-
: তোমার আসল ইস্টিশনেরই খবর নাই। তুমি রেল স্টেশনে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়ছো?
: তাইলে কী করতে বলো?
: বলছি তো একবার।
টাকা-পয়সা আসলেই একটা সমস্যার বিষয়। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কোটি কোটি টাকার নতুন নোট ছেপেছে। তারা যদি ঘোষণা দিত- যাদের টাকা-পয়সার সমস্যা আছে, ব্যাংকে এসে চাহিদাপত্র উপস্থাপন করলেই কড়কড়া নতুন নোট মিলবে; তাহলে দারুণ হতো।
দুঃখের বিষয়, তারা এ ধরনের কোনো কথা বলেনি; বরং যাদের টাকা-পয়সার কোনো সমস্যা নেই, তাদের জন্য ব্যাংকের দরজা অবারিত রাখার কথা জানিয়ে ঈদের আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পুরাতন নোট জমা দিয়ে নতুন নোট সংগ্রহ করতে বলেছে। আমি হচ্ছি 'টঙ্কাহীন' গোত্রের লোক।
হাঃ! যার পকেটে কোনো টাকাই নেই, সে টাকা অদল-বদল করবে কীভাবে? কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই; বরং লবণ বেগমকে পটিয়ে-পাটিয়ে বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাক।
লবণ বেগমের কাঁধে হাত রাখলাম। সে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল-
: আমারে কোনোভাবেই পটানোর চেষ্টা করবা না।
: কী আশ্চর্য! আমি কেন পটাপটির মধ্যে যাব? আমি শুধু তোমারে একটা তথ্য জানাইতে চাই।
: কী তথ্য?
: সরকার এই বছর যে বাজেট ঘোষণা করছে, সেইটা একটা ঘাটতি বাজেট; এই কথা কি তুমি জানো?
: এইটা জাইনা আমি কী করব?
: জানার দরকার আছে। ঘাটতি বাজেট সত্ত্বেও সরকার তো একবারও বলতেছে না- সে রাষ্ট্র চালাইতে পারবে না; বরং যতটা সুন্দরভাবে চালানো যায়, সেইভাবে দেশ পরিচালনা করার চেষ্টা করতেছে।
: কীসের সঙ্গে কী? কোথায় কদমতলা আর কোথায় ঝাউতলা!
: ঝাউতলারে কদমতলা বানানোই তো সুগৃহিণীর কাজ। এইবার উঠ। আমি বিসমিল্লাহ বইলা তোমার শরীরে ফুঁ দিয়া দিতেছি। রহমতের ফেরেশতারা তোমার সঙ্গে থাকবে।
: ফেরেশতাদের সাথে থাকার দরকার নাই। তুমি শুধু তাদের টাকার পরিমাণটা তাদের দ্বিগুণ কইরা দিতে বল। দেখি, কেমন কামেল আদমি তুমি!
এ সময় ছেলেদের একজন বললো-
: আম্মু, তুমি তো সারা দিন রান্নাঘরেই থাকবা। তোমার নতুন শাড়ির দরকার কী? লিস্ট থেইকা শাড়ি বাদ দেও।
লবণ বেগম হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
: আমার আব্বা সারা জীবন ঈদের বাজার করতে যাইয়া সবার আগে আম্মার জন্য শাড়ি কিনতেন। তারপর অন্য বাজার-সদাই। আর তোমার ছেলে কী বলতেছে, বুঝতে পারছো?
আমি নীরবে মাথা নাড়লাম। মাথা নাড়তে দেখে লবণ বেগম ক্ষেপে গেল। বলল-
: বুঝতে তো পারবাই। উপযুক্ত ছেলের উপযুক্ত বাপ।
সমঝোতায় পৌঁছতে আরও আধাঘণ্টা লেগে গেল। শপার্স টিমকে রিকশায় তুলে দিয়ে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা হলাম। আকাশের ভাবসাব সুবিধার মনে হচ্ছে না। সঙ্গে ছাতা নেই। বৃষ্টি শুরু হলে বিপদে পড়ে যাব। দ্রুত পা চালালাম। বাসে উঠে একবার বসতে পারলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। রাস্তা পার হওয়ার জন্য শ্যামলী ফুটওভার ব্রিজের ওপর পা রাখলাম।
এ সময় ফুটওভার ব্রিজের টিনশেডে নূপুর বেজে ওঠার শব্দ শোনা গেল। বৃষ্টি নামল ময়ূরের পেখম তোলার মতো ছন্দময় ভঙ্গিতে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজে আজকাল ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃষ্টি থেকে পথচারীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য এটি একটি অতি উত্তম ব্যবস্থা।
ফুটওভার ব্রিজের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটিকে দেখতে পেলাম। সারা শরীর বোরকায় আবৃত। শুধু চোখ দুটি খোলা। সে চোখে বিজলি চাহনি। এখান দিয়ে যাতায়াতের সময় প্রায় প্রতিদিনই মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। প্রথমে তাকে এ যুগের লাইলী মনে করে ভেবেছিলাম, মেয়েটি হয়তো তার প্রেমিকের জন্য রোজ এভাবে অপেক্ষা করে। বন্ধু করিমের কথায় ভুল ভাঙ্গল। মেয়েটি সম্পর্কে আমার বক্তব্য শুনে সে বলল-
: আরে ধুর!
: ধুর মানে?
: ধুর মানে ধুর।
: বুঝলাম না।
: তার আগে তুই বল, এখানে নতুন কইরা সিনেপ্লেক্স চালু হওয়ার আগে কখনও এই মেয়েরে এভাবে দাঁড়াইয়া থাকতে দেখছস?
ফুটওভার ব্রিজের ঠিক পাশেই আগে শ্যামলী সিনেমা হল ছিল। সেটা ভেঙ্গে এখন সেখানে শ্যামলী স্কয়ার নামে বহুতল বিপণিবিতান গড়ে উঠেছে। শ্যামলী স্কয়ারের এক পাশে শ্যামলী সিনেপ্লেক্স। এটা কবে চালু হয়েছে আর মেয়েটিকে ঠিক কবে থেকে এখানে দেখছি, মনে করতে পারছি না। আমাকে নিরুত্তর থাকতে দেখে করিম বলল-
: শ্যামলী সিনেপ্লেক্স চালু হওয়ার সঙ্গে মেয়েটির এখানে দাঁড়িয়ে থাকার একটা যোগসূত্র রয়েছে।
অবাক হয়ে বললাম-
: কী রকম!
: ধর, কেউ যদি মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা দেখার ইচ্ছা পোষণ করে, তাহলে প্রথমে সে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলবে এবং বনিবনা হলে সেই লোক দুটি টিকিট কিনবে। তারপর মেয়েটিকে নিয়ে সিনেপ্লেক্সে ঢুকে যাবে।
: তারপর?
: তারপর আর কী? পাশাপাশি বসে তারা সিনেমা দেখবে। চিপস-বাদাম খাবে।
: আর কিছু না?
: আর তো কিছু জানি না। আমি কখনও এই ধরনের মেয়েরে সঙ্গে লইয়া সিনেপ্লেক্সে ঢুকি নাই। তবে...
: তবে কী?
: তবে একটা মেয়ে যখন কোনো পুরুষের বিনোদন সঙ্গী হয়ে আধো-অন্ধকার সিনেমা হলে গিয়ে পাশাপাশি সিটে বসে, সেখানে নিশ্চয়ই আরও কোনো ঘটনা থাকে। সেই বৃত্তান্ত আমার অজানা।
বৃষ্টির বেগ আরও প্রবল হয়েছে। মেয়েটি দু’হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। দেখে মনে হচ্ছে, তার মধ্যে কিশোরীর চঞ্চলতা ভর করেছে। আর ক’দিন পরেই ঈদ। মুসলমানরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদ উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশের দোকানপাটে মানুষের ভিড় ও কেনাকাটার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে। আর এ মেয়েটি বিনোদন সঙ্গী হওয়ার অপেক্ষায় কারও প্রস্তাব পাওয়ার জন্য ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে!
কেউ কি বলতে পারবে- এবারের ঈদ মেয়েটির কাছে কী রঙ নিয়ে হাজির হবে? ঈদের রঙ কেমন হবে নিউমার্কেটে ছাত্র-ব্যবসায়ী সংঘাতে মারা যাওয়া মুরসালিন ও নাহিদের বাবা-মা; স্ত্রী, পুত্র-কন্যার কাছে? ঈদ কোন রঙ ধারণ করবে ইসরাইলি বর্বরতায় ফিলিস্তিনের সন্তানহারা বাবা-মা, বোন হারানো ভাই কিংবা ভাই হারানো বোনের কাছে? ঈদের আনন্দের পাশাপাশি বেদনার এ কাব্য পৃথিবীর বাতাসকে নিশ্চয়ই ভারী করে তুলবে। তবে তাতে শাওয়ালের চাঁদের কিছু যায় আসে না।
পৃথিবী নামক এই গ্রহে মানুষকে কেন্দ্র করে ঘটে চলা জাগতিক দুঃখ-বেদনা-আনন্দ তার নিয়মের কোনো ব্যাঘাত ঘটাবে না। সৃষ্টিকর্তার নিয়মের অধীন হয়ে প্রতি বছর সে আকাশে উদয় হবে। আকাশে উদয় হওয়া শাওয়ালের সে চাঁদ দেখে অনেকে খুশি হবে; আবার কেউ হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলবে...
লেখক: সাংবাদিক, রম্য লেখক।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস