শেষ বল খেলতে পারেননি ইমরান খান
তার বিরুদ্ধে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আসার পর থেকে টানা খেয়াল রাখছিলাম। ৯ এপ্রিল ২০২২ শনিবার উচ্চ আদালতের নির্দেশে ভেঙে দেওয়া সংসদ জীবিত হয়ে যখন অধিবেশনে বসে, শুরু হয় নানা নাটক। বার বার সংসদ অধিবেশনের বিরতি। তাকে দেখলাম না। এক পর্যায়ে ধরে নিয়েছিলাম আজ অনাস্থা ভোট হবে না। কারণ এর আগের রাতে জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় ইমরান খান তার সরকারকে হটিয়ে যারা আসতে চাচ্ছে, তার ভাষায় ‘আমদানি করা সরকার’, তাদেরকে গ্রহণ করবেন না বলেছেন। সেই সঙ্গে এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার জন্য রবিবার (১০ এপ্রিল) এশার নামাজের পরে জনগণকে রাস্তায় বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে, সংসদের উপর আদালতের নির্দেশ- শনিবার ভোটের আয়োজন করতেই হবে।
আমি অনলাইনে পাকিস্তানি পত্রিকায় চোখ রাখছিলাম, সেইসঙ্গে পাকিস্তান এবং ভারতের দুটি টিভি দেখছিলাম। গভীর রাতে এক পর্যায়ে মনে হয়েছিল যেন পুরো দেশটির শক্তিকেন্দ্রগুলো একটি বিপর্যয়কর সংঘর্ষের পথে। এই অচলাবস্থা দেশের সর্বোচ্চ স্তরে আঘাত করার জন্যও প্রস্তুত। নানা গুজবের মধ্যে একটি হচ্ছে ইমরান খান কোনো অবস্থায় চান না শাহবাজ প্রধানমন্ত্রী হোক। অন্য কেউ হলে মানবেন। সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রীর অফিসিয়াল বাসভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এমনকি বিবিসি উর্দুর মতো সংবাদ মাধ্যমও তা বলছে। মনে হচ্ছিল পর্দার আড়ালে ইরানের বিরুদ্ধে বিরোধী দল, উর্দি এবং আদালতের সম্মিলিতভাবে লড়ছে, যাতে ইমরান কোনো অবস্থায় আদালতের নির্দেশ অমান্য করতে না পারে। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে আমেরিকা।
সংসদীয় পদ্ধতি পরিণত হয়েছিল তখন প্রহসনে। সংসদ থেকে বড় আদালত, তার উপরে অলিখিতভাবে আর্মি- এমন কারবার পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। সমগ্র সংসদ, বিচার বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর প্রধানদের 'শেষ বল' পর্যন্ত খেলতে বাধ্য করেন ইমরান। সে কারণে রাতের অন্ধকারে আরেক খেলায় নামেন তারা। ইমরানের বিরুদ্ধে সংসদে কোনো অবস্থায় অনাস্থা ভোটের আয়োজন করবে না স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। সে খবর পেয়ে তারা তাদের দু’জনকে পদত্যাগ করতে বলেন। অথচ মিডিয়া প্রচার করছে ইমরান খান তাদেরকে পদত্যাগ করতে বলেছেন।
ঘড়ির কাঁটা দিন ফুরিয়ে যাওয়ার শেষ মহূর্তে ইমরান সম্ভবত ক্ষান্ত দেন এবং বিরোধীদেরকে তাদের ইচ্ছা পূরণের অনুমতি দেন। সংসদে অনাস্থা ভোট শুরুর আগে স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার পদত্যাগ করেন। স্পিকার কেন পদত্যাগ করছেন সেটা জানাতে তিনি একটি কাগজ দেখিয়ে বলেন যে আমি অনুরোধ করবো বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরিফকে এটা দেখার জন্য, এখানে কি লেখা আছে। আমি জানি তিনি জানেন। তার কণ্ঠে ছিল হতাশার সুর। এবং এইভাবে, সংবিধান দিবসের প্রথম প্রহরে, ১০ এপ্রিল ২০২২ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে নয়, শুনশান নিরবতার মধ্যে পিটিআই সরকার তাদের পতন দেখে। সমর্থকরা হারলেও গৌরবের সঙ্গে হারতে পারেনি।
স্পিকার আসাদ কায়সার তার আসনে এসে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে প্যানেল সভাপতি, মুসলিম লীগ নেওয়াজের সংসদ সদস্য আয়াজ সাদিককে বাকী অধিবেশন কার্যক্রম চালাতে আহ্বান করেন। আয়াজ সাদিক অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব টেবিলে আনেন দিন শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগে। শনিবারের মধ্যেই ভোটের কার্যক্রম শুরু করে পরবর্তী দিন অধিবেশন ডাকেন। বাস্তবে সেটি ৫ মিনিটের বিরতি। ৯ তারিখ শুরু করেছেন আদালতের নির্দেশ ছিল বলে আর মধ্যরাতে (রবিবারের শুরুতে) ভোটের আয়োজন করেছেন বিরোধী দলের ইচ্ছায়। সারা দিন বিরোধী দল সংসদে, এমনকি কয়েকজনকে সংসদের মূল কক্ষে জামাতে নামাজ পড়তেও দেখলাম।
ভোটের ফলাফল এলো। সফল ফলাফল শুনে গ্যালারি বসা লোকজন এমন শ্লোগান দিচ্ছিল যে তাদের চিৎকারে স্পিকারের অধিবেশন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ভোটে ৩৪২ সদস্যের সংসদে ১৭৪ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে, মানে ইমরান খানকে হটানোর পক্ষে, ভোট দিয়েছেন। সরকারি দলের অনুপস্থিতে বিপক্ষে শুন্য ভোট পড়ে। নেওয়াজ শরিফের ছোট ভাই মুসলিম লীগ প্রধান, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ নতুন প্রধানমন্ত্রীর মতোই বক্তৃতায় বলেন, আমরা জনগণের দূঃখের মধ্যে মলম লাগাতে এসেছি। আমরা প্রতিশোধ নিব না, কাউকে অন্যায়ভাবে জেলে দিব না। আইন চলবে তার গতিতে। বেনজির ভুট্টোর ছেলে পিপিপি প্রধান বিলওয়াল ভুট্টু বাবা জারদারির পাশের আসনে বসে বললেন, সব আগের মতো লাগছে। 'পুরনো পাকিস্তানে স্বাগত জানাই'। বিলওয়াল ১৯৭৩ সালে তার নানা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সময়ে এই ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের নতুন সংবিধান গৃহিত হয়েছিল, তাও শুনান।
সারাদিন সংসদে যাননি ইমরান খান। অনাস্থা শুরুর আগেই ইমরান খান অফিসিয়াল বাসভবন ছেড়ে দিয়ে তার বাসার পথে রওয়ানা হন, যদিও অফিসিয়াল বাসনভবনে তিনি রাত্রি যাপন করতেন না। এর মধ্যে তার বিদেশে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার আবেদন ফাইল হয় রাত জেগে থাকা শীর্ষ আদালতে। মিডিয়া এবং লোকজনের আচরণ কতটা রাতারাতি পরিবর্তন আসে, সব দেখছিলাম টিভিতে। ইমরানের দলের কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের খবরও ছড়িয়ে পড়ে।
সংবাদপত্রের শিরোনাম দেখলাম-No Khan-fidence. দেখে মজা পেলাম। খান সাহেব কী চাল দেন এবার কে জানে! দিনভর নাটকের শেষে তার শেষ চালগুলো যে ভালো হয়নি বা তিনি যে চাল দিতে সফল হননি তাতে আমার সন্দেহ থাকলো না। গৌরবের সঙ্গে বিদায় নেওয়ার সুযোগ থাকলেও নিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন- এটা পরিষ্কার। আমার মতে তিনি সংসদে যেতে পারতেন এবং নিজ দলের স্পিকারের মাধ্যমে ভোটের আয়োজন করে উচ্চকণ্ঠে বক্তৃতা দিতে পারতেন, যা শুধু পাকিস্তান নয় বিশ্ববাসী দেখতো। কারণ পাকিস্তানের তিনি একমাত্র নেতা যাকে বিশ্বাবাসী চেনে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে যখন তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) একক বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল, তখন পিটিআই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা তাজা বাতাসে শ্বাস নেবে। যদিও রাজনৈতিক কৌশল এবং একটি ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল এই বিজয়ের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী এবং দেশটির সাধারণ জনতা সেটা মেনে নিয়েছে। মূলত সবার ধারণা সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টা ছিল ইমরান ক্ষমতায় আসুক। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থতার কারণে, পিটিআই অগণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে হাত মেলায়। তারা এই সমঝোতা ক্ষতিপূরণ কাজের মাধ্যমে দিবে আশা করেছিল সবাই। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন জনগণকে ভূগিয়েছে। নেপথ্য কারণ জনগণ বুঝে না। তাই দায় সরকারের। ব্যবসায়ী এবং আমলারাও সরকারের বিরোধিতায় নেমেছিল। অনভিজ্ঞতার কারণে তারা সহসা জনগণকে হতাশ করেছে। এক বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের দূর্ভাগ্য যে তারা পারিবারিক রাজনীতির বাইরে পিটিআইকে বেছে নিয়েছিল কিন্তু দেশি-বিদেশি চক্রান্তের বিরুদ্ধে ইমরানের ভুল চালের কারণে তারা আবার অতীতের লুটেরা বিরোধী দলের পিছনে যেতে বাধ্য হয়েছে। যাওয়ার কালে পিটিআই কিছু প্রশংসনীয় অর্জনের রেকর্ডও রেখে গেছে। কোভিড মহামারী সফলভাবে পরিচালনা, বহুমুখী এহসাস প্রোগ্রাম এবং একটি নতুন জনস্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প অনেক নাগরিকের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। এর জন্য ইমরান খানকে অনেকেই মনে রাখবেন। তাই খানের সরকারের সময় শেষ হলেও, তার দিন শেষ না।
১০ তারিখ রাত দেশের সব কটি বড় বড় শহরের, গুরুত্বপূর্ণস্থানে পিটিআইর সমাবেশে যোগ দিয়েছে বিপুল জনতা।। শুধু তাই নয়, ইমরান খানের সমর্থকরা লন্ডনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফের বাসভবনের সামনেও বিরাট জমায়েত করেছে। নেওয়াজের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। এই অবস্থান তাদের ক’দিন থাকবে জানি না। ইমরান খানের ভাষায় তিনি সমর্থকদের নিয়ে একটি ‘বিদেশী ষড়যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ শুরু করেছেন।
বড় কোনো অঘটন না ঘটলে শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। ইমরানের পিটিআই বসবে বিরোধী দলের চেয়ারে। বিরোধী দলে থাকাকালীন ইমরান সবসময়ই একজন হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, একজন যোদ্ধা হিসেবে যে জানতো তার লক্ষ্যগুলি কী কী। তার নিরলস উদ্যোগ এবং ঐশ্বরিক মিশনের প্রচেষ্টা তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি জোরালো শক্তি করে তুলেছিল। আশা করা যায়, সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ইমরান খান আরো বিকশিত হবে। পাকিস্তানকে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক পরিবারের খপ্পর থেকে রক্ষা করবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
এইচআর/জিকেএস