তুমি রবে নীরবে...
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সাথে যিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই বীর সেনানী জেনারেল জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব (জে এফ আর জ্যাকব) চলে গেলেন। বুধবার দিল্লির একটি সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট জেনারেল। এর সাথে অবসান হলো ৯৩ বছরের বর্ণাঢ্য এক মহাজীবনের। আমরা বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু এবং বীর সেনানীকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের বীর হিসেবেই তিনি এক নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলের প্রণেতা। সে সময় তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয়ে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য ও ঐতিহাসিক। ৩৬ বছরের সামরিক কর্মজীবনে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও অংশ নেন।
জেনারেল জ্যাকব সর্বশেষ ঢাকায় এসেছিলেন ২০১২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে। সে বছরের ২৭ মার্চ ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলেন জ্যাকব। বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী ছিলেন আমৃত্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ নামের একটি ঐতিহাসিক বই লেখেন জেনারেল জ্যাকব।
বাংলাদেশের ব্যাপারে বরাবরই ছিলেন আশাবাদী। ২০১২ সালে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের লেখাতেও তিনি সেই আশার কথায়ই বলেছিলেন-
`১৯৭১ সালে যে ত্যাগ ও বীরত্বের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়েছে, আমার জীবনে সে রকম কিছু আমি কখনো দেখিনি। সমগ্র জাতি সেদিন একটি মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের পরপর বাংলাদেশে প্রায় কিছুই ছিল না। অথচ আজ সেখানে শিল্প ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। গ্যাস ও তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি তো মনে করি, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ইতিমধ্যেই যে অগ্রগতি সাধন করেছে, তা তাকে অদূর ভবিষ্যতে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে পৃথিবীর বুকে পরিচিত করে তুলবে। পাকিস্তানের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, অর্থাৎ বাংলাদেশে কলকারখানা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো মনোযোগই দেয়নি। সেখানে আজ বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি।`
যার হৃদয়ে সব সময় জাগরূক থেকেছে বাংলাদেশ, তাকে বাংলাদেশের মানুষ কি কখনো ভুলতে পারে? তাই কবির ভাষায় বলতে হয়, চলে যাওয়ার নামই প্রস্থান নয়। তুমি রবে নীরবে, প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
এইচআর/আরআইপি