গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব এবং কিছু প্রস্তাবনা
গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল সরকার। গত সাড়ে তিন মাসে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এই বিরূপ প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কারণ, এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু জ্বালানি তেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গণপরিবহনসহ বাজারের সব নিত্যপণ্যের ওপর গিয়ে পড়েছে।
এই যখন অবস্থা, তখন আবার খবর এসেছে- দেশের গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে খাতভেদে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বা তারও বেশি হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের ওপর ২১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চারদিনের গণশুনানি করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
গণমাধ্যমে খবর এসেছে, চলতি অর্থবছরই সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ৭০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন। কিন্তু এর বিপরীতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেই কেবল ভর্তুকির চাপ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সরকারি কর্মকর্তারা। এজন্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গত মাসে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে একটি অবাস্তব প্রস্তাব পেশ করে, যেখানে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি করার কথা বলা হয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। কারণ, অতীতে কখনই এতো বেশি পরিমাণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি।
যদিও এই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আইন ও প্রবিধান অনুসারে উত্থাপিত না হওয়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও (বিইআরসি) শুরুতে আমলে নেয়নি। কিন্তু এতে দমে না গিয়ে নতুন করে আবারও আবেদন করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। মানে যেভাবেই হোক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘরে তুলতে হবে এমন একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা।
সম্ভবত একেই বলে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। কারণ, যখন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে, অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে বিকল্প ব্যবস্থায় রান্নার কাজ চলছে, পূর্ব ইউরোপীয় দুই দেশের যুদ্ধ বাংলাদেশের বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে- তখনই দাম বাড়ানোর এই পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড়ের আগেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এক্ষেত্রে তারা বলছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের পাইকারি দামও বাড়াতে হবে। কারণ, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। ফলে গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাধ্য হয়েই বাড়াতে হবে। তদুপরি সারও উৎপাদন করা হয় গ্যাস পুড়িয়ে। তাহলে ইক্যুয়েশন বলছে দাম বাড়বে সারেরও। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষিতে। তাছাড়া এই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে আরও নানা রকমের অপ্রাসঙ্গিক মূল্যবৃদ্ধিও যোগ হবে।
কিছুদিন আগে এমনিতেই ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এক দফা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মানে হলো- তা সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে আরেকটি বড় ধাক্কা আসা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই কিন্তু বাড়বে না, দেশের শিল্প-কারখানা তথা শিল্পক্ষেত্রেও পড়বে এর নেতিবাচক প্রভাব। এই মূল্যবৃদ্ধি উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা ধনিক শ্রেণির জীবনমানে তেমন প্রভাব ফেলবে না হয়তো; কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষকে যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে, তা বলাইবাহুল্য।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছর প্রতিটি গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিই গড়ে ২০-২২ শতাংশ মুনাফা করেছে। এ অবস্থায় এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে একেবারেই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। এদিকে লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। কিছুদিন আগে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেছেন, এতে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে নিট ও গার্মেন্ট শিল্প।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এমনিতেই অনেকেই দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। কাজ হারানোদের বেশিরভাগই হয়তো নতুন করে কাজ পেয়েছে কিন্তু সমাজ অর্থনীতির সব পর্যায়ে এখনো অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র বিদ্যমান।
এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া উৎপাদন-বণ্টনসহ মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। তার পরিবর্তে এই বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে থাকা দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করাসহ সিস্টেম লস কমিয়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে কীভাবে ভর্তুকির চাপ কমানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে।
কারণ, খোদ রাজধানীর অনেক এলাকায়ই বৈধ সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা অনেক বেশি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মদদেই এসব অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের কোনো বৈধ সংযোগ না থাকলেও এখানকার প্রতিটি ঘরেই জ্বলে গ্যাসের চুলা। কেবল বাসা নয়, বস্তির দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোতেও রয়েছে তিতাসের এই অবৈধ চুলার সংযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তিতাসের লোকজনের মাধ্যমেই পাওয়া যায় এই সংযোগ। শুধু কড়াইল বস্তি নয়, রাজধানী এবং এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে না পারলে গ্যাসের দাম বার বার বাড়িয়েও লাভ নেই।
যদিও পেট্রোবাংলা বিশ্ববাজারে এলএনজির দামের ঊর্ধ্বগতিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করছে। কিন্তু গ্যাসের এ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বিইআরসির একজন সদস্যের বরাত দিয়ে কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, পেট্রোবাংলা বর্তমানে সিস্টেমে যে ৩০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে, তার মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এগুলো আসছে কাতার আর ওমান থেকে।
দেশ দুটির সাথে এলএনজি আমদানির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির শর্তানুসারে আগামী ৮-১০ বছরে এটার দাম খুব একটা ওঠানামা করার কথা নয়। ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিজস্ব উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে, যেটা বেশ সস্তা। অনেক কম খরচেই উৎপাদন করা হয়। আর বাকি থাকা ১৫০ মিলিয়নের মতো গ্যাস স্পট মার্কেট থেকে কেনা হয়, যেটার দাম তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। কথা হচ্ছে, ৭০ শতাংশ দেশীয় উৎসের সহজলভ্য গ্যাস থাকার পরও এর প্রভাব বাজারে কতটা পড়তে পারে যে একবোরে দ্বিগুণের বেশি মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে?
তাছাড়া গ্যাস নিয়ে যদি সংকট সৃষ্টি হয়-ই তবে মূল্যবৃদ্ধি না করেও সংকট সমাধানের আরও পথ খোলা আছে। প্রথমত দেশে নতুন যেসব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু উত্তোলন শুরু হয়নি সেগুলো থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া খনি ও কূপগুলোর আরও গভীরে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের হাইপ্রেশার জোনগুলোতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন কূপ খনন করা। দ্বিতীয়ত, গ্যাস খাতের চুরি ও অপচয় কমিয়ে এনে রাজস্ব বাড়ানো। সরকার ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই সময় মাত্র ১০ শতাংশ বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করার পর অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও কার্যক্রমটি পুনরায় চালু হয়েছে। এবার এক লাখ প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা হবে। গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধে এই কার্যক্রমটিকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সবখানে প্রিপেইড মিটার চালু হলে কেবল সরকারের রাজস্বই বাড়বে না, গ্রাহকদেরও সাশ্রয় হবে।
বঙ্গোপসাগরের নিচে ব্যাপক গ্যাস ও তেলসম্পদ আবিষ্কার ইতিমধ্যেই ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বের বড় বড় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দেশ দুটির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রজয় ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বড় অর্জন। এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।
সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে। সমুদ্রজয় তাদের বড় একটি সাফল্য হলেও এখনও সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকার গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ দেশের জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে এবং সংকট থেকে রক্ষা করতে সাগরের গ্যাসই হতে পারে রক্ষাকবচ।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, কৃষির মতো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সব সরকারই প্রয়োজন অনুসারে কম বেশি ভর্তুকি দিয়ে যেমন এসেছে তেমনি রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুসারে মূল্যবৃদ্ধিও করেছে। তবে মূল্যবৃদ্ধি করতে গিয়ে জনজীবনে তার প্রভাব কতটা পড়বে, তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, করোনার ভয়াবহ আক্রমণে এমনিতেই মানুষ বিপর্যস্ত।
ফলে টিসিবির লাইন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। কারণ সেখানে সহনীয় দামে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া এখন লাইনে কেবল নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্তই নয়, মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াচ্ছে। দাঁড়াচ্ছে বললে ভুল হবে, দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আবারও যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে এ চাপ সাধারণ মানুষদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। মূল্যবৃদ্ধির আগে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: কবি, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম