বড় বেশি প্রয়োজন ছিল
মার্চ মাসটা বরাবরই বাঙালির জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ। পাশাপাশি বারো মাসে তের পার্বণের এই বাংলাদেশের ক্যালেন্ডারে প্রতিটি মাসেই এমন এক বা একাধিক তারিখ আছে যেগুলো আমাদের স্বাধীনতার সুদীর্ঘ সংগ্রামের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যেও মার্চ মাসটা আলাদা, কারণ মার্চের ১৭-তে জন্ম জাতির পিতার, যার জন্ম না হলে এদেশের জন্ম হতো না।
৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের ডিফেক্টো স্বাধীনতা। ২৫ মার্চের কাল রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উন্মত্ত বর্বরতায়, যার প্রেক্ষিতে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
এরও অনেক আগে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথমাবারেরমত কারাবরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু আর সেদিন থেকেই মূলত সূচনা হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকারের দুই যুগের কঠিন সাধনার, যার চূড়ান্ত পরিণতি ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মার্চ তাই আক্ষরিক অর্থেই বাঙালির জন্য ‘হ্যাপেনিং মার্চ’। আর মার্চের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলোর তালিকায় সর্বশেষ সংযোজনটি হচ্ছে ২১ মার্চ। গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পায়রায় দেশের বৃহত্তম তাপবিদ্যুত কেন্দ্রটির উদ্বোধন করলেন।
এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের ঝুলিতে জমা হলো আরেকটি সোনালী অর্জন। এখন থেকে বাংলাদেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত একটি ভূখণ্ড। মার্চের ২১ সঙ্গত কারণেই তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে আমাদের বলায়-লেখায় আর বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বারবার ঘুরে-ফিরে আসবে এই তারিখটি। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ যখন ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশের’ ব্যবচ্ছেদ করতে বসবে তখন এই বাংলাদেশের সাফল্যগাথার সেই বাংলাদেশের বিশ্লেষণ ২১ মার্চকে বাদ দিয়ে কখনই পূর্ণাঙ্গ হবে না।
তবে আমার কাছে মার্চের ২১-এর গুরুত্ব আরো একটি কারণে অনেক বেশি। কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের মধ্যে এটাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স। প্যান্ডেমিক শুরু হওয়ার পরপর সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে তার নিজের এবং তার সরকারের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নিতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়ে পড়েছিলেন গণভবন কেন্দ্রিক আর সরকার ভার্চুয়াল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
পুরো প্যান্ডেমিক জুড়েই অবশ্য বাংলাদেশের গল্পটা বরাবরই ঘুরে দাঁড়ানোর। কী কোভিডের মৃত্যুর মিছিলকে বশে রাখা, তো কি অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা, কোভিডের এই পুরোটা সময়ই এসব প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের রোল মডেল। কোভিড মোকাবেলায় সাফল্য যেমন বাংলাদেশকে টেনে তুলেছে ব্লুমবার্গের সফলতমদের তালিকায়, তেমনি বাংলাদেশ নাম লিখিয়েছে সেই হাতেগোনা গুটিকয় দেশের এলিট ক্লাবে যারা প্যান্ডেমিকের সময়ও প্রবৃদ্ধির কাটাকে ঋণাত্মকে যেতে দেয়নি।
বাংলাদেশের সর্বশেষ কোভিড সাফল্য ভ্যাকসিনেশনে। পৃথিবীতে কোটির উপর জনসংখ্যা আছে কমপক্ষে নব্বইটি দেশের, অথচ ভারত আর চীনের পর বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে একদিনে এক কোটি মানুষকে কোভিড ভ্যাকসিন দেয়ার দুরূহতম কাজটি করে দেখানো সম্ভব হয়েছে। আর যদি নিজস্ব ভ্যাকসিন সক্ষমতার কথা বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা নিজেদের উৎপাদিত কোন ভ্যাকসিন না থাকা সত্ত্বেও ‘একদিনে এক কোটির’ এই লক্ষ্যমাত্রাটি সাফল্যের সাথে উতরে গেছে।
আজ যখন পায়রায় প্রধানমন্ত্রী, তখন কোভিড পরাজিত তার কাছে। বাংলাদেশ এখন দিনের পর দিন টানা মৃত্যুহীন কোভিডের দেশ। পায়রায় প্রধানমন্ত্রীর শরীরী উপস্থিতি তাই শুধু অন্ধকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের ঘোষণা নয়, বরং তা কোভিডকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করায় ‘বাংলার বাঘিনীর’ গর্বিত হুংকারও বটে।
তবে ২১ মার্চের গুরুত্বটা এখানেও শেষ হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সাথে যাদের কথা বলার সুযোগ হয়েছে তাদের সবার অভিজ্ঞতা একটি জায়গায় এক রকম। আর তা হলো তার মমতাময়ী দিকটি। মায়ের মমতায় তিনি আগলে রেখেছেন গোটা দেশকে। আর আমরা যারা আম জনতা, আমাদের বুকটা সাহসে ফুলে-ফেঁপে দশ হাত হয়ে যায় যখন আমরা প্রধানমন্ত্রীকে দেখি দেশটা চষে বেড়াতে।
গণভবনের দুয়ার খোলা আর তিনি গণভবনের বাইরে মানেই তিনি আছেন দেশটা জুড়ে। তিনি মিশছেন-জানছেন-বুঝছেন আর তার হাতে নিজ-নিজ ভবিষ্যতকে নিরাপদ জেনে আমরা ছুটছি যে যার কাজে। প্রধানমন্ত্রী তাই গণভবনকেন্দ্রীক হয়ে পড়লে, তা সে যতই যৌক্তিক কারণেই হোক না কেন কিংবা বাংলাদেশে পঞ্চান্ন হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাইরে উড়ে গেলে, তা সে যত গুরুত্বপূর্ণ কাজের তাগিদেই হোক না কেন, পুরো দেশের মানুষ, আমরা প্রত্যেকেই এক ধরনের অসহায় বোধ করি আর কেমন যেন একটা বিশাল শূন্যতা এসে তখন কেন যেন আমাদের গ্রাস করতে চায়।
বলাই বাহুল্য এসব সুযোগের সন্ধানে তৎপর থাকে সুযোগের সন্ধানীরাও। তারা জানে এ দেশটাকে এই ‘মমতাময়ী মা’ আগলে রেখেছেন এক হাতে। এর যত সংকট আর ঝুট-ঝামেলা তাও তিনি সামলাবেন ঐ এক হাতেই। হাজার মাইল দূরের অচেনা কোন এক ইউক্রেনে যুদ্ধের অজুহাতে তাই এদেশের কাঁচাবাজারে আগুন লাগে, লাফিয়ে বাড়তে থাকে ভোগ্যপণ্যের দাম, যতক্ষণ না বিষয়টি হাতে নেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
ফাঁকে-তালে কোথাকার কোন হামজা সাহেবও পেয়ে যান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি, ঐ যতক্ষণ না তা শুধরে দেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীই। পুরো করোনাকালে গোটা জাতি এই সংকটে নিমজ্জিত ছিল। একেতো করোনার ভয়, তার চেয়ে ভয় মাঠে-ঘাটে প্রধানমন্ত্রীর শরীরী অনুপস্থিতিতে কখন যে কি হয়! আর যথারীতি এই সংশয় আর সংকটে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে সবটা সময় সর্বোচ্চ সক্রিয়তা দেখিয়েছে ঐ সুযোগ সন্ধানীর দল। নিজেদের ষোল আনা গুণে নেয়া আর মার সাথে সন্তানের বোঝাপড়ায় ঘুণ ধরাতে তারা ছিল ঘুমহীন।
প্রধানমন্ত্রীর পায়রা উপস্থিতি তাই শুধু আঁধারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় আর বাঙালির কোভিড বিজয়ের সাক্ষ্যবহই নয়, বরং তা বাঙালির সংশয়- মুক্তি আর মনস্তাত্ত্বিক বিজয়েরও সাড়ম্বর ঘোষণাও। এর আসলেই বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/জিকেএস