ইতিহাসের পাতায় অমর থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ফারাজী আজমল হোসেন
ফারাজী আজমল হোসেন ফারাজী আজমল হোসেন
প্রকাশিত: ১২:০৪ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২২

যতদিন পৃথিবীর বুকে থাকবে বাঙালি অথবা বাংলাদেশের নাম, ততদিন অমর হয়ে থাকবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে কখনওই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বই বাঙালিকে দিয়েছে নিজেদের রাষ্ট্র।

শুধু রাষ্ট্রই নয়, জাতিকে আত্মনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালিরই নয়, দুনিয়ার সকল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মুক্তির প্রতীক। তিনি না থাকলে আমাদের লাল-সবুজের দেশ পেতোনা নিজেদের পতাকা। বাঙালির বাংলায় কথা বলার অধিকারও স্বীকৃতি পেতোনা পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে। তার কারণেই বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কিউবার মুক্তিসূর্য ফিদেল কাস্ত্রো তাই তুলনা করেছিলেন হিমালয় পর্বতের।

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালির মুক্তির আসল সূর্য ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। প্রকৃত অর্থেই তিনি জাতির পিতা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৩ সালে গোপালগঞ্জ থেকেই তিনি সাবেক পূর্ববঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ভাষা আন্দোলন করেছিলেন। ভাষার চেতনাকে ধারণ করেছিলেন বুকে। তার চিন্তা-চেতনায় ছিল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি বিধানের সংকল্প। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। গবেষকদের লেখায় উঠে এসেছে সেকথা।

বঙ্গবন্ধু কলকাতায় অধ্যয়নকালেই রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় ঐতিহাসিক বেকার হোস্টেলে ছিলেন। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাঁর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার ঘটনার কথা আছে। তিনি লিখেছেন, 'এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছুদিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই পক্ষের মধ্যে আপোষ করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে।'

প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। বাঙালি জাতিসত্তা ছিল তার কাছে সবার আগে। পাকিস্তানের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে বাঙালির জাতিসত্তার বিকাশের লড়াইকে তিনিই গতি দেন। ১৯৭০ সালে তার নেতৃত্বেই অবিভক্ত পাকিস্তানে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু মানুষের ভোটে জয়লাভ করলেও সেনাবাহিনীর কর্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন আপোষহীন সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু। একাত্তরের ৭ মার্চ তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আজও বাঙালির শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। রমনা রেসকোর্সে তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ সেইসঙ্গে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

কবি নির্মলেন্দু গুণের মতে, ‘তারপর থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসাবে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।

মার্শাল ল-কে কাজে লাগিয়ে পূর্ববঙ্গে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে শুরু হয় দমন-পীড়ন। ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় গণহত্যা, অপারেশন সার্চ লাইট। পাকিস্তানি বর্বরতার শিকার হয় গোটা বাঙালি জাতি। গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু তারই নির্দেশে বাঙালি গর্জে ওঠে পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে। ৩০ লাখ শহিদ আর প্রায় তিন লাখের বেশি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুই এই স্বাধীনতার স্থপতি। তিনি জেলে থেকেই বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। তারই নির্দেশে একাত্তরের ২৬ মার্চ ঘোষিত হয় স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা তিনি।

বাঙালি জাতির জন্য মুক্তি কামনায় ভারত বঙ্গবন্ধুকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে চাপ সৃষ্টি করে দিল্লি। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব আর ভারতীয় সেনাদের পেশাদারিত্বের কাছে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের পর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়ে। ইসলামাবাদ বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে সেদিন লাখো বাঙালি তাদের মুক্তিসূর্যকে স্বাগত জানাতে সমবেত হন। দেশে ফিরেই যুদ্ধক্লান্ত দেশকে নতুন করে গঠন করার কাজে হাত দেন তিনি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ করে গোটা দুনিয়ার সামনে নজির সৃষ্টি করতে চান জাতির পিতা। দেশকে স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি বাঙালির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও নিরলস চেষ্টা চালান বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান মদদপুষ্ট ঘাতকের দল নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে। রাজাকার, আল-বদররা যেমন পাকিস্তানি সেনাদের ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তেমনি ক্ষমতা লোভী পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনাকে দেশে না থাকায় তারা প্রাণে বাঁচেন। পরবর্তীতে তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয় ভারত।

ঘাতকের দল বাঙালির স্বাধীনতার চেতনাকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফের সোনার বাংলা গড়ার লড়াই শুরু করেছে। তার আদর্শকেই হাতিয়ার করে বাংলাদেশ ফের এগিয়ে চলেছে।

একাত্তরের গণহত্যায় পাকিস্তানকে মদদ যুগিয়েছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। ভারত ছিল প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের বন্ধু। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন। তাই চিরকাল বলে এসেছেন, 'আমার জনগণের সেরা বন্ধু ভারতের জনগণ।'

পাকিস্তানি সেনা কর্তারা চাপ দিলেও কাশ্মীর নিয়ে কখনও ভারত বিরোধিতায় তাকে দেখা যায়নি। নির্ভীক বঙ্গবন্ধু খুন হতে পারেন জেনেও কখনও পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। মাথা উঁচু করে তিনি দেশের জন্য আত্মবলিদান দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে বারবার উঠে এসেছে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেওয়া শেষ ভাষণেও বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানানা। তিনি বলেছিলেন, 'ভারতে আমার এক কোটি লোক আশ্রয় নিয়েছিল; তার জন্য আমরা নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব। আমি তাদের স্মরণ করি, খোদার কাছে মাগফেরাত কামনা করি, যারা এদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে, আত্মাহুতি দিয়েছে। আমি তাদের কথা স্মরণ করব যে সকল মুক্তিবাহিনীর ছেলে, যে সব মা-বোনেরা, আমার যে কর্মী বাহিনী যারা আত্মাহুতি দিয়েছিল শহীদ হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। এদেশ তাদের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে। আজ আমি স্মরণ করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা জীবন দিয়েছিল বাংলার মাটিতে। তাদের কথাও আমি স্মরণ করি।'

বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের জাতির পিতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন গোটা দুনিয়ার জন্যই মুক্তিসূর্য।

তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। ২০০৪ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ধারে কাছেও ছিলোনা, সেই সময় বিবিসি একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে বিবিসির স্রোতারা শেখ মুজিবুর রহমানকেই শ্রেষ্ঠবাঙালি বলে নির্বাচিত করেন। বাঙালির মুক্তিদাতা তিনি। বাঙালীকে বসবাসের জন্য দিয়েছেন একটি বাংলাভাষী রাষ্ট্র। নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও পাকিস্তান সেনার কাছে আত্মসমর্পণ না করে গোটা দুনিয়ার বুকে বাঙালির সম্মানকে উন্নীত করেছেন। বাঙালির নির্ভীক চরিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। তার অসাম্প্রদায়িক ও নির্ভীক চেতনাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। তাই 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।'

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।