ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও কিছু কথা
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওইদিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্র কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। কোনো ধরনের আপসের পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন।
সম্প্রতি ইউনেস্কো মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করেছে। বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। পৃথিবীর কোনো ভাষণ কোনো দেশে এতবার প্রতিধ্বনিত হয়নি। ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয় এই ভাষণটি কালজয়ী যুগোত্তীর্ণ ভাষণ।
এ ভাষণে তার তেজস্বিতা ও সম্মোহনী ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। এ ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণ মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলে। এ ভাষণ ছিল বহুমাত্রিকতায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল।
বাঁধভাঙা মানুষ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদি স্লোগানে ঢাকার আকাশ-বাতাস-মাটি সেদিন কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল। অথচ লাখো জনতা গ্রাম-বন্দর-অলিগলি থেকে ছুটে চলেছেন রেসকোর্স ময়দানের দিকে। এই দিনের রেসকোর্স ময়দানের ঘটনাবলির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ৮ মার্চের দৈনিক পাকিস্তান লিখেছে- ‘মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে মনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। স্লোগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। লক্ষ কণ্ঠে এক আওয়াজ।
বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লক্ষ কণ্ঠের বজ্রশপথ। হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে পূর্ব বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা। লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্ঠি মুহুর্মুহু উত্থিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালির সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক, শতকোটি শতকোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের প্রতীক বাঁশের লাঠি মুহুর্মুহু স্লোগানের সাথে সাথে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে। এই ছিল গতকাল রোববার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ৮ই মার্চ, ১৯৯১, পুস্তক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব)
দেশ-বিদেশ থেকে সাংবাদিকরা এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনতে, তারা অবাক হয়ে গেলেন জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা দেখে। স্বাধীনতার জন্য একটি জাতি যে কিরূপ উদ্দাম, উৎকণ্ঠিত ও উদ্বেল হয়ে উঠতে পারে তা দেখে সেদিন দেশ-বিদেশের সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।
বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি দেখলেন সবাই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে তার নির্দেশ শোনার জন্য। দেখলেন বাংলার মানুষ শুধু তার কথায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইলেন তিনি। তারপর জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন তার নির্দেশাবলি।
ওই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’
পুরো জাতি তাদের যা কিছু আছে তা নিয়েই প্রিয় নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’র ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে। ওইদিনের জনসভার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে বলেছেন, লাঠি, ফ্যাস্টুন হাতে লাখ লাখ জনতা উত্তপ্ত স্লোগানে মুখরিত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। তখনই রেসকোর্স ময়দানজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।
ঐতিহাসিক ভাষণের সেই ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই তেজদীপ্ত ঘোষণাই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি, তেমনি ছিলেন সবার অতি আপনজন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কর্মপ্রয়াস ছিল বাংলার জনগণের শোষণ ও মুক্তির অন্বেষণ। বড় বিচিত্র, বর্ণাঢ্য আর কীর্তিতে ভরা তার সারাটা জীবন।
বাংলাদেশকে সব ধর্মের সব মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণার্থে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ভৌত অবকাঠামোগত পদক্ষেপ যেমন ছিল, তেমনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের বিষয় বিবেচনায় রেখে তিনি ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গ্রহণ করেছিলেন বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা। তিনি যেমন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, তেমনি বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামের প্রচার-প্রসারের স্থপতিও তিনি। এ দুটি অনন্য সাধারণ অনুষঙ্গ বঙ্গবন্ধুর জীবনকে দান করেছে প্রোজ্জ্বল মহিমা।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। তাহলো বঙ্গবন্ধু ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন এবং সম্মান করতেন। এই গুণটি ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশেষ গুণ।
বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলমান তেমনি তার পুরো পরিবারও ছিল প্রকৃত ইসলামের অনুসারী। বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পরিবার এবং বাবার মতো নিষ্ঠার সাথে ইসলাম ধর্ম পালন করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু ইসলাম ধর্ম পালন করলেও অন্য ধর্মের প্রতি ছিলেন সমান শ্রদ্ধাশীল। তিনি কোনোদিন অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এবং ভিন্ন ধর্মের প্রতি কোনোরূপ বিরোধিতা করেননি বরং তাদের সহায়তা করেছেন।
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতেও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী। তিনি বলেছিলেন- ‘...আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।’ বঙ্গবন্ধুর এ স্বপ্ন পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
শেষে এটাই বলব, বঙ্গবন্ধু জীবনের একটি মুহূর্তও অযথা ব্যয় করেননি। তার জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আজকের প্রজন্মের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মূল্যবোধের সেতুবন্ধ তৈরি করে দিতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা অব্যাহত রেখে আমাদের দায়িত্ববোধের প্রমাণ রাখতে হবে।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস