ইতিহাস বদলে দেওয়া একটি রাজনৈতিক কবিতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ৭ মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দেশের আপামর জনগণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে ঘোষণা করেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এ ঘোষণার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেন।
মাথার ওপর কাঠভাঙা রোদ-উত্তাপ, মাথার ওপরে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার উড়ছে, তবু বাংলার লাখ লাখ জনতা একাত্তরের এই ঐতিহাসিক দিনে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অপেক্ষা করছিল তাদের কিংবদন্তি নেতা ও আশা-আকাঙক্ষার প্রতীক-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য শোনার জন্য।
সেখানে উপস্থিত জনতাসহ গোটা দেশ তার নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি মঞ্চে প্রবেশ করে গণসমুদ্রের দিকে হাত নাড়িয়ে শুরু করলেন “ভাইয়েরা আমার; আজ দুঃখ ভাড়াক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে”।
একজন রাষ্ট্রনায়কের বক্তৃতার একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো তিনি বক্তব্যের মাধ্যমে তার অনুসারীদের শুধু ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাই প্রদান করবেন না বরং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু সেই কাজটি করতে পেরেছিলেন।
৭ মার্চের ভাষণটি লিখিত বক্তব্য না হলেও এটি ছিল তথ্যনির্ভর ও দিকনির্দেশনামূলক, যার মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব থেকে শুরু করে সমাপন পর্যন্ত একটি পথরেখা এঁকে দিয়েছিলেন। এটি এতটাই আকর্ষণীয় ও কবিতাময় ছিল যা লাখ লাখ বাঙালিকে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে উৎসাহিত করেছিল।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এর পূর্বে সমগ্র বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো এরকম ভাষণ বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এমন এক সম্মোহনী শক্তি ছিল, যা দেশের সব জনগণের মধ্যে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য আবেগের সঞ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই বক্তব্য আমাদের একই রকমভাবে আবেগতাড়িত করে তোলে। এসব দিক বিবেচনা করেই অনেক ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে আব্রাহাম লিংকনের ‘Gettysburg Address’ ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘I have a Dream’ ভাষণের সাথে তুলনা করেছেন। এই ভাষণকে এদের সাথে তুলনা করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ওই ভাষণগুলোর চেয়েও শক্তিশালী কারণ একটি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি জাতির আজন্ম লালিত স্বাধীনতার স্বপ্নের যে রূপরেখা তৈরি হয়েছিল, যা ইতিহাসে সম্ভবত এক এবং অদ্বিতীয়। এই কারণেই ইউনেসকো ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে পৃথিবীর তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ২০১৭ সালে। এই স্বীকৃতির ফলে এ ভাষণের গুরুত্ব দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও সমানভাবে ছড়িয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি এমন একটি সময়ের যখন স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্র করে পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম-পাকিস্তানের সামরিক সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল। পশ্চিম-পাকিস্তানের এই ষড়যন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের কাছে তার ভাষণের মাধ্যমে একটি দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন এবং সবাইকে বেসামরিক যুদ্ধে প্রস্তুতের জন্য বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’।
পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত খুব কম নেতাই আছেন যিনি দেশের সর্বসাধারণকে ‘তুমি’ বলার মতো ভালোবাসা হৃদয়ে ধারণ করতেন। প্রিয় নেতা প্রাণপ্রিয় মুজিব ভাইয়ের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়াজ তোলে ‘সব কথার শেষ কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ মুক্ত করো’।
বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্য শেষ করেন এই বলে যে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, কিন্তু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ’। তার এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তিনি জাতিকে প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনা দেন। এই বক্তব্যের মাধ্যমে পৃথিবীর সামনে রাজনৈতিক নেতা ও কূটনৈতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পরিপক্বতাকে উপস্থাপিত হয়েছে। দৃঢ়চিত্তে এই শব্দাবলি উচ্চারণের মাধ্যমে কূটনৈতিক ভাষায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। কিন্তু দেশের আপামর মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের সারবত্তা ছিল জলের মতো পরিষ্কার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঊষালগ্ন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ ভাষণই মূলত ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব-পাকিস্তানে এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার জন্য আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৬ মার্চ, ১৯৭১ সালের সেই বৈঠকটি থেকে কোন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়নি কারণ ইয়াহিয়া খান উদার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেননি।
মূলত, কালক্ষেপণ করার কৌশল হিসেবে এই বৈঠকটির ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। আলোচনার অন্তরালে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার জন্য পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে প্রচুর পরিমাণ সৈন্য পূর্ব-পাকিস্তানের আনা হয়। এর মধ্যে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর বর্বরোচিত হামলা পরিচালনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাদের নির্দেশনা প্রদান করেন খুনি ইয়াহিয়া খান। প্রকৃতপক্ষে, ‘অপারেশন সার্চলাইট’র জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সব ধরনের আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করে। ফলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তব্যের রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। কারণ বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ এর মার্চ মাসের প্রথম দিকে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ প্রশ্নে বিভিন্ন দল ও জোটের চাপের মধ্যে ছিলেন। এই ভাষণটি এমন এক সময় প্রদান করা হয়েছিল যখন বাঙালি জাতি পশ্চিম-পাকিস্তানি সেনা শাসকদের নিপীড়ন ও বঞ্চনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
এছাড়া তৎকালীন সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরেও বঙ্গবন্ধুর হাতে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। সময়টি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জণগণের জন্য ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল।
বঙ্গবন্ধু অপরিসীম প্রাজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছিলেন, যে কোনো ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। ফলে আন্দোলনের গভীরতা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সাধারণ ও প্রাঞ্জল ভাষায় সুচিন্তিতভাবে তার বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থাপন করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুর সততা ও দৃঢ়তা শ্রোতাদের মধ্যে এক ধরনের বৈদ্যুতিক প্রবাহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যা পরে বিদ্যুতের গতিতে সারাদেশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পথ পরিবর্তিত হয়েছিল। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি জাতিকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গভীরতা নিছক একটি বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এটি বাংলাদেশের জাতিসত্তা রক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য ম্যাগনা কার্টা হিসেবেই ইতিহাসে বিবেচিত হবে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিবেচনা করে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ. এ ফিল্ড ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ শীর্ষক গ্রন্থে এই ভাষণটিকে গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষণের মধ্যে অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন। এই বক্তব্যের যথার্থতা আমরা খুঁজে পাই যখন দেখি আজও বাংলাদেশের আপামর মানুষ প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হয়।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস