কৈশোরের প্রেম: প্রেম নাকি...?
তখন পড়ন্ত বিকেল। শীত যায় যায় করছে আর কোথায় যেন বসন্তের আগমনী বার্তা। শুকনো পাতা ঝরানো পিচ ঢালা পথে পায়ে পায়ে হেঁটে এসে গলির মুখে পৌঁছতেই নিঃশব্দতা ভাঙলো রাহাত। ‘এটা তোমার’- বলেই একটা নীল খাম এগিয়ে দিল নীরার দিকে। একটু চমকে গিয়েই পরমুহূর্তে হাতের কাচের চুড়ি বাজিয়ে খামটি নেবার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল নীরা। সলজ্জ হাসি মাখা রাঙ্গা মুখে শুধু বলল ‘আসি’। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় যতদূর চোখ যায় চেয়ে দেখল নীরার চলে যাওয়া। আর রাহাতের কিশোর মনের বৈশাখী ঝড় আড়াল হলো গোধূলি লালের আবছা কুয়াশায়।
অনুভূতি সাথে নিয়েই জন্ম হয় মানুষের। সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় তার ধরন, জেঁকে বসে বহুবিধ কারণ আর কখনো, মানে না কারো বারণ। এই ধরন কারণ আর বারণের ঘেরাটোপে নিত্যই ছোটে মন। কখনো এ মন যুক্তি যুক্ততায় শীতল শান্ত দিঘীর মতো আবার কখনো মুক্তির আস্বাদনে বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল ঢেউ, যা আঁছড়ে পড়ে অনুভবের তটে।
ব্যক্তির শৈশবে এই অনুভবের পরশগুলো কেবল ডানা মেলতে শুরু করে। নতুন নতুন অনুভূতিতে শিহরিত হতে উন্মুখ হয়ে থাকে মনের নরম জমিন। কৈশোরে সেই অনুভূতির সতেজ ভূমিতে শেকড় ছড়ায় এক নতুন শিহরণ। নড়ে চড়ে ওঠে মনের গহীনে। তৈরি হয় ভালোলাগার অদম্যতা। মান চায় অশরীরী বাঁধন। সহজ শব্দে আমরা যে বাঁধনকে বলে উঠি প্রেম।
দেহের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে মনের চৌহদ্দি আর স্বভাবতই বাড়তে থাকে তার চঞ্চলতা। সেই চঞ্চলতার স্রোতে যদি প্রেম এসে মিশে যায় তাহলে তো অস্থিরতার সমুদ্র গর্জে উঠবেই।
কিশোর বয়সে কাউকে মনে ধরেনি বা কাউকে ভালো লাগেনি অথবা কাউকে ভেবে মুহূর্ত থমকে যায়নি এমন মানুষ পাওয়াই দায়। কিন্তু এই কিশোর বয়সেই যখন আপনার সন্তানটি একটু চঞ্চল, উচ্ছল কিংবা অস্থির হয়ে উঠছে, তখন কেন আপনি দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন? সন্তান আপনার গোল্লায় গেল বলে হা-হুতাশ? একটা বারও কি জানতে চেয়েছেন সন্তানের মনে কী খেলে যায়?
প্রথমেই যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন, তা হলো-কিশোর বয়সের প্রেম কী? বহু মনোবিজ্ঞানীর মতে কিশোর বয়সের প্রেম আসলে প্রকৃত অর্থে প্রেমই নয়। কারণ প্রেমের সজ্ঞায়নে যেসব সম্পৃক্ততা বা সম্পর্কের গাঢ়ত্ব থাকা প্রয়োজন বলে মনে করা হয়, তার অধিকাংশই কিশোর প্রেমে অনুপস্থিত। প্রেমের প্রধানতম শর্ত: 3Cs,অর্থাৎ caring, commitment এবং completeness এর যথাযথ উপস্থিত না থাকার কারণে অথবা এগুলোর আবশ্যিকতা বোঝার মত পরিপক্ক না হওয়ার জন্যই কিশোর প্রেম যথার্থ প্রেম হয়ে উঠতে পারে না। এ কেবল বয়:সন্ধি কালের স্বাভাবিক নিয়মে অপর লিঙ্গের প্রতি কৌতূহল কিংবা আকর্ষণের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কিন্তু কিশোর বয়সের প্রেমের অনুভূতি কিংবা প্রেমে প্রত্যাখাত হওয়া অথবা সম্পর্কের ভাঙ্গন কোনোটিকেই কিন্তু ছোট করে দেখলে চলবে না। কারণ এর জের কখনো বয়ে বেড়াতে হয় ব্যক্তিকে সারাজীবন। আর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ মসৃণ করার ক্ষেত্রে সন্তানের সাথে আপনার সম্পর্কই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রথমত: কৈশোরে পা দেবার প্রাক্কালে আরেকবার ঝালাই করে নেয়া প্রয়োজন সন্তান-মা-বাবার বন্ধুত্বের সম্পর্ককে। এটি একদিনে হয়ে ওঠার নয়। সন্তানের সামনে নিজেদের অর্থাৎ বাবা-মায়ের সম্পর্ককে সুন্দর-সাবলীল স্বাভাবিক ভালোবাসার মুগ্ধতার সম্পর্ক হিসেবে নজির রাখুন। যেন-ছোট থেকেই সন্তানটি ছেলে-মেয়ের মাঝের সম্পর্ককে বন্ধুত্বের, নির্ভরতার এবং স্বভাবজাত বলে ভাবতে শেখে।
পাশাপাশি কখনোই যেন শিশুর কাছে বিপরীত লিঙ্গের মানুষটি ‘সকল কৌতুহলের আধার’ হয়ে না ওঠে এবং ভালোলাগার ও তা প্রকাশ করার বিষয়টি (অভিভাবকের কাছে) অমার্জনীয় অপরাধ হয়ে না দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত: সন্তানকে জীবনের অগ্রাধিকার বাছাইয়ের শিক্ষা দিন। কোন সময়ে কোন বিষয় প্রাধান্য পাওয়া উচিত এবং কেন উচিত তা বুঝিয়ে বলুন। এক্ষেত্রে বইয়ের ভাষায় কথা বলে কোনো লাভ নেই বরং জীবন ঘনিষ্ঠ উদাহরণ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায় তবেই ভালো ফল পাওয়া যাবে।
তৃতীয়ত: এমন একটি ক্ষেত্র তৈরি করুন যেন আপনার সন্তান তার মনের কথা সর্বপ্রথম আপনাকে বলার জন্য উদগ্রীব থাকে। ভয়, লজ্জা, দ্বিধা কোনো কিছুই যেন এখানে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। পাশাপাশি অভিভাবক হিসেবে আপনাকেও লক্ষ্য রাখতে হবে সন্তানের আচরণের প্রতি। প্রয়োজনে আপনিই হাসিমুখে জানতে চান কাউকে ভালো লেগেছে কিনা।
চতুর্থত: অপরের মতামতকে গ্রহণ করার কিংবা সম্মান করার শিক্ষা দিতে হবে সন্তানকে প্রথম থেকেই। তা না হলে সম্পর্কের ভাঙ্গন অথবা প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যান কিশোর বয়সের অপরিণত মনকে বিক্ষিপ্ত, বিক্ষুব্ধ এমনকি বিপন্নও করে তুলতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে নিজের ক্ষতির সাথে সাথে অপরপক্ষের ক্ষতির চিন্তাও জেঁকে বসতে পারে।
সর্বোপরি সন্তানের কৈশরে প্রেমে পড়ার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে আপনার নিজের। বিষয়টির ভালো মন্দ দিক সন্তানের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেকেও তৈরি হতে হবে এমন ঘটনা সুন্দর ভাবে সামলে নেবার।
শুরু করেছিলাম নীরার কাছে দেয়া রাহাতের নীল খাম দিয়ে। কৌতুহল জাগতেই পারে জানার জন্য যে কী ছিল সেই নীল খামে? আর কীই বা উত্তর এসেছিল রাহাতের জন্য?
সেদিন নীরা নীল খাম হাতে বাড়িতে গিয়েই খিল দিয়েছিল নিজের ঘরে। দম বন্ধ করা উত্তেজনা নিয়ে খামটি খুলেছিল সে। চারভাঁজে ভাঁজ করা নীল কাগজে লেখা ছিল শুধু দুটি বাক্য। ‘তুমি এতো রাগী কেন? আমার ভয় লাগে’। -এমনই সহজ সরল কিশোর প্রেমের স্বীকারোক্তি আর এমনই নির্বোধ নিষ্পাপ কিশোর বয়সের অস্থিরতা।
লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/এমএস