পাঁচ প্রজন্মের স্মৃতি নিয়ে চলে গেলেন লতা

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

গানের প্রতি ভালোবাসা আমার ছেলেবেলা থেকেই। গানের প্রতি মানে গান শোনার প্রতি। পরে চেষ্টা করেছি বটে, কিন্তু অল্পতেই বুঝে গেছি আমার গলায় সুর নেই। তবে গান শোনার ভালোবাসাটা কখনো কমেনি। ভালোবাসা থাকলেও ছেলেবেলায় সেই ভালোবাসা মেটানোর সহজ উপায় ছিল না।

সত্তরের দশকে আমাদের গ্রামে কিছুই ছিল না- বিদ্যুৎ ছিল না, টেলিভিশন ছিল না। আমাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট্ট একটা রেডিও। অনুরোধের আসর চাওয়া পাওয়া, আধুনিক গান, নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত- শোনা যেতো রেডিওর কল্যাণে।

প্রচলিত অর্থে সংসার করা হয়নি লতার। চিরকুমারী লতার সংসার ছিল গান। প্রায় আট দশক গানের সঙ্গে সংসার অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। প্রায় এক হাজার ছবিতে গেয়েছেন তিনি। গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। আমি শুধু তার গাওয়া বাংলা এবং হিন্দি গান শুনেছি। কিন্তু লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় গেয়েছেন, গেয়েছেন বিদেশি ভাষায়ও। এই অনন্য রেকর্ড বিশ্বের আর কারও নেই।

বিজ্ঞাপন

আমাদের গ্রামের চাচাতো ভাই কাশেম হঠাৎ একদিন একটা ‘চেঞ্জার’ কিনে আনলেন। এখনকার প্রজন্মকে জিনিসটা চেনানোই মুশকিল হবে। এমনিতে বলা হতো ‘টু ইন ওয়ান’, যাতে রেডিওর পাশাপাশি ক্যাসেটেও গান শোনা যেতো। চেঞ্জ করা যেতো বলেই কি গ্রামে এটাকে চেঞ্জার বলতো? আমি ঠিক জানি না।

তারপর দ্রুত চেঞ্জার বেশ জনপ্রিয় হয়ে যায়। গ্রামের অনেকেই কাজের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতো। দেশে ফেরার সময় সবাই আর কিছু আনুক আর না আনুক একটা চেঞ্জার অবশ্যই আনতেন। বলছিলাম কাশেম ভাইয়ের চেঞ্জারের কথা। সেই চেঞ্জার চিরদিনের জন্য চেঞ্জ করে দিল আমার গান শোনার স্মৃতি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কাশেম ভাই চেঞ্জার কেনার সাথে সাথে বেশ কয়েকটি ফিতার ক্যাসেটও কিনে আনলেন। সেখানেই প্রথম শুনি, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে…’। সময় ৭৬-৭৭ হবে হয়তো। তবে সে গানটি তখনকার ছিল না। সম্ভবত গানটি আমার জন্মের আগে গাওয়া। সেই যে লতা মঙ্গেশকরের সুরের জালে বাঁধা পড়লাম। আর বেরোনো হয়নি, বেরোনোর কোনো ইচ্ছাও নেই, উপায়ও নেই।

লতা মঙ্গেশকর বেঁচে ছিলেন ৯২ বছর। শেষ কয়েক বছর বয়সের কারণে সেভাবে আর গাইতে পারেননি। তবে তিনি বেঁচেছিলেন, এটাই অনেক বড় স্বস্তির খবর ছিল। আমরা লতা মঙ্গেশকরের সময়ে বেঁচে ছিলাম, এটা বড় সৌভাগ্য মানি। বয়সের কারণেই তার যে কোনো অসুস্থতার খবর গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে উৎকণ্ঠিত করে রাখতো।

লতার যে কোনো খবরই অনেক বড় খবর। গত ৮ জানুয়ারি করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হন। একই সঙ্গে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। করোনামুক্ত হলেও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। শনিবার রাতে যখন তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়, তখনই গভীর শঙ্কাটা চেপে বসে। রোববার সকালেই শোকের চাদরে ঢেকে যায় ভূ-ভারত- কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর আর নেই।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

লতা মঙ্গেশকরের জীবন কানায় কানায় পূর্ণ। সঙ্গীত পরিবারে তার জন্ম। পিতা দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। বাবার আগ্রহেই গানের সাথে তার গাটছড়া বাঁধা, যা কখনোই ছিন্ন হয়নি। লতা মঙ্গেশকরের পুরো পরিবারই সঙ্গীতময়। তার ছোট বোন আশা ভোসলে আরেক কিংবদন্তির নাম।

প্রচলিত অর্থে সংসার করা হয়নি লতার। চিরকুমারী লতার সংসার ছিল গান। প্রায় আট দশক গানের সঙ্গে সংসার অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। প্রায় এক হাজার ছবিতে গেয়েছেন তিনি। গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। আমি শুধু তার গাওয়া বাংলা এবং হিন্দি গান শুনেছি। কিন্তু লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় গেয়েছেন, গেয়েছেন বিদেশি ভাষায়ও। এই অনন্য রেকর্ড বিশ্বের আর কারও নেই। অন্য ভাষায় কেমন গাইতেন জানি না, বাংলা ভাষায় যখন গেয়েছেন, একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি বাঙালি নন।

লতা মঙ্গেশকরের পুরস্কার-পদকের তালিকা দিতে গেলে আলাদা লেখা লিখতে হবে। বলা ভালো, একজন ভারতীয়র পক্ষে যত স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব, তার সবই পেয়েছেন তিনি। আসলে কোনো পুরস্কার বা পদক দিয়ে লতাকে সম্মানিত করা সম্ভব নয়, বরং লতাকে দিতে পেরে সেই পদক বা পুরস্কারই মর্যাদাপূণ হয়েছে। ভারতের বাইরে থেকেও স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। তবে এসব পদক বা পুরস্কার দিয়ে লতাকে মাপা যাবে না।

বিজ্ঞাপন

আট দশক ধরে কোটি মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় প্রাপ্তি একজন শিল্পীর জীবনে আর কিছু হতে পারে না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, লতা মঙ্গেশকরের গান শোনেননি, তাকে ভালোবাসেননি; এমন একজন মানুষও ভারতীয় উপমহাদেশে নেই। লতা মঙ্গেশকর থাকতেন মুম্বাইতে। পাসপোর্টে তিনি ভারতীয়। কিন্তু লতা মঙ্গেশকর আসলে সব দেশের, সব মানুষের। সীমানা, কাঁটাতারের বেড়া, রাজনৈতিক বৈরিতা- লতা মঙ্গেশকর ছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এবার চলে গেলেন সবকিছুর চির ঊর্ধ্বে।

লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, এমনটি বললে ঠিক বলা হবে না। একজন মানুষের পক্ষে যা দেওয়া সম্ভব, তার সবটাই উজাড় করে দিয়েছেন এই সুরসম্রাজ্ঞী। টানা আশি বছর কণ্ঠে এমন মাধুর্য ধরে রাখা ঈশ্বরের বিশেষ কৃপা ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা সৌভাগ্যবান ঈশ্বর তাকে উজাড় করে দিয়েছেন। আর সেটা লতার কণ্ঠ হয়ে পৌঁছেছে আমাদের কানে, আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মননে।

আগেই বলেছি, তিনি বেঁচেছিলেন, এটাই সবার জন্য স্বস্তির ছিল। সে স্বস্তিটুকু একেবারে হারিয়ে গেল বটে। কিন্তু লতা বেঁচে থাকবেন, তার গানের মধ্য দিয়ে চিরদিন। তার মতো কেউ কখনো ছিলেন না, আর কখনো আসবেনও না।

বিজ্ঞাপন

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ফেসবুকে একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, মোবাইলে বাজছে, ‘ওপাড়ের ডাক যদি আসে, শেষ খেয়া হয় পাড়ি দিতে। মরণ তোমায় কোনোদিনও পারবে না কভু কেড়ে নিতে…’। আর সেই গান শুনতে শুনতে শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন শিশুর মতো অঝোরে কাঁদছেন। আখতার হুসেনের বয়স কত জানেন? ৭৬ বছর!

একজন শিল্পী একজন মানুষকে কতটা আচ্ছন্ন করলে ৭৬ বছর বয়সেও এমন কান্নায় ভেসে যাওয়া যায়! আমি জানি শুধু আখতার হুসেন নন, ভারতীয় উপমহাদেশের সব বয়সের কোটি কোটি মানুষ আজ শোকে আচ্ছন্ন। শুরুতে আমার গান শোনার স্মৃতির কথা বলেছি। আমরা প্রেম করেছি লতার গানে, বিরহ উপভোগ করেছি লতার গানে। শুধু আমি নই, আমার আগের দুই প্রজন্ম, পরের দুই প্রজন্মও লতার গানেই বুঁদ হয়ে আছে। পাঁচ প্রজন্মের গান শোনার স্মৃতি নিয়ে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর। আমি নিশ্চিত, সামনের আরও অনেক অনেক প্রজন্ম লতাকে দূর থেকে ভালোবেসে যাবে। মরণ কভু লতা মঙ্গেশকরকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

বিজ্ঞাপন

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।