অগ্নিদগ্ধ মানুষের ভিড় ঠেলে


প্রকাশিত: ০২:৩৮ এএম, ০৮ জানুয়ারি ২০১৬

৫ জানুয়ারিকে একদল মানুষ গণতন্ত্র হত্যা দিবস বলে প্রচারে ব্যস্ত। যারা এরূপ প্রচারে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছেন তারা গণতান্ত্রিক চর্চায় কতটা বিশ্বাস করেন সে বিষয়েও আছে প্রশ্ন। যদি বিশ্বাসই করতেন তবে তারা ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণের সুপরামর্শ দিতেন। নিদেনপক্ষে, ঐ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় তার সমালোচনায় মুখর হতে পারতেন। কিন্তু কার্যত এর কোনোটিই দৃশ্যমান হয়নি। নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাবের কারণে নির্বাচন থেকে বিরত থাকার ‘রাজনৈতিক নিয়তি’ ভোগের প্রতিশোধ জনগণের ওপর নেয়া যায় না।

নির্বাচনে না গিয়ে বিকল্প পথে ক্ষমতায় যাওয়ারও আর কোনো অবকাশ এদেশে আপাতত নেই। এটাও তাদের উপলব্ধি করতে হবে। বুঝতে হবে যে, ৫ জানুয়ারির ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অবরোধ’ কর্মসূচি ছিল একটি জনবিচ্ছিন্ন এবং হঠকারী ঘোষণা। যে ঘোষণার কারণে পরবর্তী তিনটি মাস সমগ্র বাংলাদেশ একটি তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়ে উঠেছিল। তাই আমরা বরং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিকে অগ্নিসন্ত্রাসের জন্মদিন বলে সনাক্ত করতে চাই। সনাক্ত করতে চাই জ্বালাও-পোড়াও ও পেট্রোল বোমাবাজির মহোৎসবের জন্মদিন হিসেবে। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অবরোধ’ কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে বিএনপি দেশের সর্বত্র যাকে বলে ‘টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া’ পর্যন্ত ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এই অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশের ভেতর জঙ্গিবাদের উত্থান পর্বের মহড়া ত্বরান্বিত হয়েছে। ত্বরান্বিত হয়েছে পুড়িয়ে মানুষ মারার ভয়ংকর অভিনব এক কৌশল। আর এই কৌশলটি ৫ জানুয়ারির পরের তিনটি মাস এদেশের মানুষকে একেবারে দিশেহারা ও বিপর্যস্ত করে ছেড়েছে। সাধারণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মী-ক্যাডাররা।

নিজেদের রাজনৈতিক ভুলে ক্ষমতা হারানো কিংবা জনবিচ্ছিন্ন বিএনপি স্থিতিশীল একটি সরকারের বিরুদ্ধে তথা এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু দেশবাসীর কাছে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের এই ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়ে যায়। ২০ দলীয় জোটের অমানবিক নৃশংসতায় জনগণ বিএনপি-জামায়াতের এই ‘অবরোধ’ কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু তবু বিএনপি নৃশংসতার পথ পরিহার করেনি। বরং আরো বশি বেপরোয়া হয়ে উঠে জ্বালাও-পোড়াও আর পেট্রোল বোমা হামলার মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটায় অনবরত। তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, চিকিৎসক, ব্যাংক-কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, পরিবহন শ্রমিক, দিন মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা কেউ।

গত বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী তিন মাসে তাদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমা ও অগ্নি সংযোগে দগ্ধ, অঙ্গার ও পুড়ে ছাই হয়ে মারা গেছে ১৫৩ জন সাধারণ মানুষ। নৃশংস ও নারকীয়ভাবে তারা আহত করেছে ২ হাজারেরও বেশি মানুষকে। এদের অনেকেরই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, কারো হাত, কারো বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে বেঁচে থাকবার প্রত্যাশায়। অনেকেরই মুখ-মণ্ডল হয়ে গেছে বিকৃত ও বিবর্ণ। আগের নামের মানুষটির সাথে তার বর্তমান চেহারা ও অবয়বের কোনো মিল নেই! কী এক ভয়ংকার তাণ্ডব শুরু হয়েছিল গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে! এসব ভাবতেও বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে ওঠে! বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট মানবিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গেছে ক্ষমতার মোহে। ইতিহাসের ক্লেদাক্ত সেই ৫ জানুয়ারির অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে ২০ দলীয় জোটের কর্মী-ক্যাডারদের আক্রমণ ও অগ্নি-সংযোগের শিকারে পরিণত হয়েছে ২ হাজার ৫০০ যানবাহন। ৫ শতাধিক পুলিশ সদস্য অগ্নিদগ্ধ কিংবা পেট্রোল বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন। বেপরোয়াভাবে পিটিয়েও আহত করা হয়েছে সরকারি এই বাহিনীর সদস্যদের। বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা সরকারি ও অন্যান্য স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে প্রায় পঞ্চাশটির মতো [সূত্র : বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস : বর্বরতার ১০০ দিন]। সব মিলিয়ে সেসময় অগ্নিদস্যুতার নানা অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত সাধারণের নাগরিক জীবনকে করে তুলেছিল দুর্বিষহ। এদেশের মানুষের কত শ্রমঘণ্টা নষ্ট করেছে তারা তার হিসেব করা কঠিন। হিসেব করা কঠিন এদেশের কতো শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় কী পরিমাণ ক্ষতিসাধন তারা করেছে। তারচেয়েও বেশি কঠিন সেই তিন মাসে দেশবাসীর মনস্তাত্ত্বিক জগতকে কতটা বিপর্যস্ত করেছে সেই হিসেব করা।

তাই ৫ জানুয়ারি প্রকৃত-অর্থেই বাঙালির ইতিহাসের এক কালো দিন। আর এই দিনটির জনক-জননী বিএনপি এবং দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। ক্যালেন্ডারের পাতায় ৫ জানুয়ারি দেখে আমরা হতবিহ্বল হই বিএনপির নৃশংস নিষ্ঠুরতায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া বাস হেলপার সোহাগ হাওলাদের কথা মনে করে। ১৮ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে অবরোধ চলাকালে বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার বামরাইল এলাকায় পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে যে ট্রাকটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল তার হেলপার ছিল সোহাগ। আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার একটি পার্কিং করা বাসে ঘুমন্ত হেলপার সতেরো বছরের কিশোর তোফাজ্জলের কথা মনে করে। রাতের বেলায় তোফাজ্জল বাসে ঘুমিয়েছিল- বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা সে বাসে চোরাগোপ্তা আগুন ধরিয়ে দেয়। আর সেখানেই সে পুড়ে অঙ্গার ও ছাই হয়ে মৃত্যুবরণ করে। নারায়ণগঞ্জের আড়াই বছরের শিশু সফির বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে কী অমানবিক যন্ত্রণায় ছটফট করেছে তার খোঁজ কোনো বিএনপি নেতা-নেত্রী  নিতে যাননি। রাজনীতি কী জিনিস তা বুঝেনা সফির। কিন্তু এক অপরাজনৈতিক জিঘাংসার শিকারে পরিণত হতে হয়েছে তাকে।

সফিরের মতো আরো অনেক শিশু রাজনীতি বুঝতো না। কিন্তু রাজনীতির ভয়াল ও ভয়ংকর ছোবল তাদের জীবনকে করে দিয়েছে অসহনীয় উপলব্ধির সমান্তরাল। এদের মধ্যে আড়াই বছরের জুঁই, ছয় বছরের রূপা আক্তার, বারো বছর বয়সী নাজিম, পনেরো বছর বয়সী মিনহাজুল ইসলাম অনিক ও শাহরিয়ার হৃদয়সহ আরো কতো নাম ও কতো চেহারার মানুষ। এরা কেউ শিশু, কেউ বৃদ্ধ কেউ বা কর্মক্ষম শক্তিশালী নারী ও পুরুষ, কেউবা মেধাবী ও তুখোড় শিক্ষার্থী। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতায় এরা প্রত্যেকেই আজ বরণ করেছে দুর্ভাগ্যের নির্মম নিয়তি। বরণ করে নিয়েছে পঙ্গুত্ব! বিগত বছরের তিন মাসের দীর্ঘ সময়ে পেট্রোল বোমা আর আগুনে পুড়ে পুড়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা, বেড়েছে বিকৃত ও বিবর্ণ চেহারার মানুষের সংখ্যা। এরকম আর কতো মৃত্যু কতো যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের কথা বলবো! কত বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষের কথা স্মরণ করে আমরা কবি কথিত ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা’ জাগাবো? বিস্মিত হই এই ভেবে যে, এত মৃত্যু, যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের এত হাহাকার ও আর্তনাদেও বেগম জিয়া তার ‘অবরোধ’ প্রত্যাহার করেননি। আগুনে, ত্রাসে, সন্ত্রাসে দুঃসহ যন্ত্রণার ৫ জানুয়ারি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হয়েছে, আর দীর্ঘতর হয়েছে বিএনপির অগ্নিদস্যুতার কালো ইতিহাসের পথরেখা।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যারা গণতন্ত্র গেল গেল বলে চিৎকারে ৫ জানুয়ারিকে দীর্ণ বিদীর্ণ করে তোলেন তারা আসলে জঙ্গিবাদকেই মদদ দিয়ে চলেছেন। আর গত বছরের দীর্ঘ তিন মাস সময়ব্যাপী যারা পুড়িয়ে মানুষ মারার বীভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তাদেরকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একইসাথে সেসময়ে নিহত হওয়া ১৫৩ জন এবং অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিকলাঙ্গ হওয়া ২ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষের পঙ্গুত্ববরণকে বৈধতা দিতে চেষ্টা করছেন। এই গোষ্ঠীর কাছে কোনোভাবেই দেশবাসী নিরাপদ নয়-  মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশটিও এদের কাছে মারাত্মক অনিরাপদ। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বিকৃত, বিবর্ণ ও বিকলাঙ্গ হওয়া ২ হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষের পঙ্গুত্ববরণের ক্ষতি কি বিএনপি কি ২০ দলীয় জোট কখনো পুষিয়ে দিত পারবে? তারা কি পারবে মানবিক মহাবিপর্যয় থেকে এদের পরিত্রাণের পথ দেখাতে? যে নামের মানুষটিকে আগে আমরা চিনতাম তার মুখায়বয়ব আগের মতো করে দিতে? জানি সব প্রশ্নের একই উত্তর হবে- ‘না’। গণতন্ত্রের নামে আমরা এইসব অগ্নিদগ্ধ মানুষের ভিড় ঠেলে কোথায় দাঁড়াবো। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে, দুলক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়াবে?

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।