সরকারি অফিসের কাজকর্ম
জমির দলিল হয়ে যাওয়ার পর নামজারি বা মিউটেশন করতে হয়। জমিজমার ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। নামজারির উদ্দেশ্যে ভূমি অফিসে দলিলের ফটোকপিসহ অন্যান্য দরকারি কাগজপত্র ও ফি জমা দেওয়ার পর অবশেষে একদিন ডাক এলো। সাতঘাটের জলপান শেষে নামজারির যে সনদ হাতে পেলাম, সেটা দেখে উৎফুল্ল হতে পারছি না। ভূমি অফিসের যে কর্মকর্তা এটা সরবরাহ করলেন, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম-
: ভাই, দলিলে স্পষ্টভাবে আমার নাম লেখা আছে মোকাম্মেল হোসেন। আর আপনেরা লেখছেন মোফাক্কেল হোসেন। এই রকম কেন করেছেন?
কর্মকর্তা আমার হাত থেকে কাগজটা নিলেন। দলিলের সঙ্গে কয়েকবার মিলিয়ে দেখার পর বললেন-
: ভুলটা মনে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয় নাই। যাই হোক, আপনে এক কাজ করেন। নাম সংশোধনের জন্য একটা আবেদন করেন। ঠিক কইরা দিব।
ভূমি অফিসের অভিজ্ঞতা সামনে রেখে বন্ধু মাসকাতের কথা মনে পড়ল। মাসকাত ও আমি একই বছর অষ্টধার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছি। পাস করার পর শিক্ষাবোর্ড থেকে মাসকাতের যে সার্টিফিকেট এলো, তাতে দেখা গেল, লেখা রয়েছে মেসওয়াক আহম্মদ। পিতা-মাতার দেওয়া নামের কৌমার্য রক্ষা করতে মাসকাত পরের সপ্তাহেই শিক্ষাবোর্ডে ছুটে গেল।
সেখানে তাকে বলা হলো- তার নাম যে মেসওয়াক আহম্মদ নয়, মাসকাত আহমদ; এই মর্মে নোটারি পাবলিকের কাছে এফিডেভিট করাতে হবে। তারপর দেশের কোনো একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিষয়টা দেশবাসীকে অবহিত করতে হবে। মাসকাত অবাক হয়ে বলল-
: ভুল তো করছেন আপনারা! আমি কেন পয়সা খরচ করে নোটারি করব? পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যাব?
বোর্ডের কেরানি মাসকাতের দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন এ ধরনের কথা আগে সে কখনও শোনেনি। চোখ পিটপিট করে মাসকাতের উদ্দেশে সে বলল-
: পয়সা খরচ করতে আপনার আপত্তি থাকলে আপনি শুধু টাকা খরচ করেন, যান।
মাসকাত আরও কিছুক্ষণ তর্ক করল। লাভ হলো না। তাকে জানানো হলো, এটাই নিয়ম। মাসকাত নিয়ম মেনে নোটারি পাবলিকের অফিসে গিয়ে এফিডেভিট করাল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিল। এরপর তাকে ব্যাংক থেকে নির্ধারিত টাকার পে-অর্ডার সংগ্রহ করতে বলা হলো। সব কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ভুল নামে ইস্যু করা সার্টিফিকেট জমা নিয়ে সংশোধনকৃত সার্টিফিকেট সংগ্রহের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হলো।
কথায় বলে, নাপিত দেখলে মানুষের বগল পরিষ্কার করার প্রয়োজন বেড়ে যায়। মাসকাত বোর্ড অফিসে যাতায়াত করছে শুনে তার গ্রামের এক মাদ্রাসা ছাত্র বলল-
: ভাইজান, গত বছর দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার সময় পরীক্ষার হল থেকে আমার রেজিস্ট্রেশন কার্ড মিসিং হইছে। পরীক্ষায় পাস করলে বিষয়টা লইয়া কোনো ঝামেলা হইত না; কিন্তু ফেল করায় সমস্যা হইয়া গেছে। এই বছর পরীক্ষা দিতে হইলে ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন কার্ড সংগ্রহ করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই।
মাসকাত মাদ্রাসা ছাত্রের ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন কার্ড সংগ্রহের দায়িত্ব নিল। মাদ্রাসা বোর্ড থেকে তাকে প্রথমে থানায় জিডি করতে বলা হলো। এরপর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও ডুপ্লিকেট রেজিস্ট্রেশন কার্ডের ফি বাবদ ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে দরখাস্ত করতে বলা হলো। সব কাজ সম্পন্ন করে দরখাস্ত জমা দেওয়ার জন্য সে কাউন্টারে গেল। কাউন্টারের লোকটা কাগজপত্র নেড়েচেড়ে বলল-
: ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এই দরখাস্ত জমা নেওয়া যাবে না। যান, অনুমতি নিয়ে আসেন।
মাসকাত দায়িত্বপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কক্ষে গেল। শুনল, তিনি মধ্যাহ্নভোজন সারতে অফিসের বাইরে গেছেন। মাসকাত অবাক হয়ে পিয়নকে বলল-
: বেলা বারোটা না বাজতেই উনার দুপুরের খাবার খাওয়ার প্রয়োজন পইড়া গেল!
মাসকাতের কথা শুনে পিয়ন খুব মজা পেল। হাসতে হাসতে মাসকাতকে সে বলল-
: ভাই, এই কথাটা আপনে ওনারে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করবেন।
বেলা তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর মাসকাত ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে চলে এলো। পরদিন সকালবেলা গিয়ে শুনল, ওই কর্মকর্তা কম্পিউটার সেকশনে গেছেন।
: কম্পিউটার সেকশন কয় তলায়? পিয়নকে জিজ্ঞেস করল মাসকাত।
: এইটা তো এইখানে না; ধানমণ্ডিতে। উত্তর দিল পিয়ন।
নাওয়া-খাওয়া ভুলে বিকেল চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও মাসকাতকে নিরাশ হতে হলো। মাঝখানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় একদিন পর গিয়ে মাসকাত শুনল, ওই কর্মকর্তার এক আত্মীয় মারা গেছে। ছুটি নিয়ে তিনি মৃতের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে গেছেন। এরপর সাতদিন বোর্ডের পথ মাড়াল না মাসকাত। এক সপ্তাহ পর গিয়ে কর্মকর্তার দেখা মিলল। তিনি সদয় হয়ে দরখাস্তে অনুমতি প্রদান করে মহামূল্যবান দস্তখত দিলেন। মাসকাত দরখাস্ত জমা দিতে গিয়ে দেখল, কাউন্টারে কোনো লোক নেই। ভেতরে গিয়ে একজনের উদ্দেশে মাসকাত বলল-
: ভাই, কাউন্টারের লোক কই গেছে?
: কী জন্য?
: দরখাস্ত জমা দেব।
: একটার পরে দরখাস্ত জমা নেওয়া হয় না।
: একটা তো বাজে নাই। মাত্র পৌনে একটা বাজে।
: আপনের ঘড়িতে কয়টা বাজে, সেইটা দিয়া তো আমাদের কোনো প্রয়োজন নাই। মসজিদে আজান হইছে, শুনছেন? খালি দুনিয়াদারি করলেই চলবে, আখেরাতের কাম-কাজ কিছু করা লাগবে না? আপনে দরখাস্ত নিয়া আগামীকাল আসেন।
পরদিন মাদ্রাসা বোর্ডে গিয়ে মাসকাত ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো। দূর-দূরান্ত থেকে আগত লোকজন পুঁটলি-পাটলা হাতে কাউন্টারের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরখাস্ত জমা নেওয়ার মতো কেউ সেখানে নেই। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মাসকাত শুনল, এখানে আগে যে লোক ছিল, তাকে অন্য সেকশনে বদলি করা হয়েছে। মাসকাত সেকশন অফিসারকে জিজ্ঞেস করল-
: যাকে বদলি করা হইছে, তার পরিবর্তে অন্য কাউকে এইখানে দেওয়া হয় নাই?
: না।
: এইটা কী রকম কথা! এই যে বিভিন্ন জেলার লোকজন সকাল থেইকা দাঁড়াইয়া রইছে, এদের তাইলে কী উপায় হবে?
: এই কথা আমারে জিজ্ঞাসা না কইরা বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, যান।
চেয়ারম্যানের কাছে যাওয়ার কথা শুনে ভুক্তভোগীরা লাফিয়ে উঠল। দলবেঁধে সবাই চেয়ারম্যানের কাছে যাওয়ার পর জানা গেল, তিনি মিটিং করতে অফিসের বাইরে গেছেন; কখন ফিরবেন, ঠিক নেই। এ কথা শুনে সবাই হইচই শুরু করলে চেয়ারম্যানের বিপক্ষ দলের এক নেতা চিকন স্বরে পরামর্শ দিল-
: ভাইয়েরা। বোনেরা। আপনেরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিছিল দেন।
মিছিল করার ব্যাপারে লোকজনের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দেখা গেল। কিন্তু হঠাৎ একজন জননিরাপত্তা আইনে মামলা খাওয়ার আশংকা ব্যক্ত করতেই অনেকের মূত্রথলির চাপ বেড়ে গেল; তারা তাড়াতাড়ি টয়লেটে ঢুকল। অনেকের আবার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেল; তারা হোটেল অভিমুখে ধাবিত হলো।
পরবর্তী দুই সপ্তাহ বোর্ডের নাম মুখে আনল না মাসকাত। পনের দিন পর কাউন্টারে বসে থাকা নতুন লোকটা ঝটপট দরখাস্ত জমা নিয়ে মাসকাতের হাতে একটা রসিদ ধরিয়ে দিল। মাসকাত হা করে দম ছাড়ল। কিন্তু বাড়ি এসে সেই ছাত্রের হাতে রসিদ ধরিয়ে দিতেই সে বলল-
: ভাই, রসিদে আলিমের পাশে টিকচিহ্ন ক্যান! আমি তো দাখিল পরীক্ষার্থী।
আলিম-দাখিলের গিঁট্টু ছাড়াতে মাসকাতকে আবার মাদ্রাসা বোর্ডে যেতে হলো। রসিদ দেখিয়ে ঘটনা বলতেই কাউন্টারের লোকটা বলল-
: আমি তো এই বিষয়ে আপনেরে ওই সময় জিগাইলাম। আপনে তো মিয়া কোনো কথাই বললেন না!
: দরখাস্তে কী লেখা আছে, সেইটা আপনে দেখবেন না?
: অত দেখাদেখির টাইম কোথায়? কাম কী একটা? অসুবিধা নাই, এখনই ঠিক কইরা দিতেছি।
ঠিক করার কথা বলে লোকটা অনেকক্ষণ ফাইলপত্র ঘেঁটে বিরসবদনে বলল-
: আপনের দরখাস্ত পাওয়া যাইতেছে না। দেইখা আসেন তো ডেলিভারি সেকশনে পাঠাইয়া দিছে কিনা?
মাসকাত ডেসপাস সেকশনে খোঁজ করে জানল, ওখানে দরখাস্ত পাঠানো হয়নি। অবশেষে একগাদা কাগজপত্রের স্তুপের ভেতর থেকে সেটি উদ্ধার হলো। প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে লোকটা বলল-
: এই যে দেখেন, ঠিক কইরা দিলাম।
: ধন্য হইলাম। এইবার একটু কষ্ট কইরা আপনের ঠ্যাং দুইটা বাড়াইয়া দেন স্যার।
: কেন!
: আপনেরে কদমবুসি করতে চাই।
লোকটা অবাক হয়ে মাসকাতের দিকে তাকাল। তার অবাক ভাব কেটে যাওয়ার আগেই মাসকাত ওখান থেকে চলে এলো। এবার তার নিজের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার পালা। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে সংশোধনকৃত সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর মাসকাত আর্তনাদ করে বলল-
: এইখানে 'মদ' না হইয়া 'মেদ' হইছে কেন?
সার্টিফিকেট যার দায়িত্বে সংশোধন হয়েছে, মাসকাতের বিলাপ শুনে তিনি বললেন-
: কিসের মদ, কিসের মেদ!
: সার্টিফিকেটে আমার নাম মাসকাত না লেইখা মেসওয়াক লেখা হইছিল। এইটা ঠিক করা হইছে; কিন্তু আহমদে যাইয়া 'মদ' না লেইখা 'মেদ' লেখা হইছে।
: অঃ। মেদ বাইড়া গেছে? দেন, মেদ কমাইয়া দেই।
: কী করবেন!
লোকটা ড্রয়ার থেকে একটা ব্লেড বের করে বলল-
: এই যে ব্লেড দেখতেছেন, এই ব্লেড দিয়া 'এ-কারের' চান্দি খাইয়া ফেলব।
: ঘঁষামাজার মধ্যে গেলে তো আমি আগেই যাইতে পারতাম। তাইলে এত ভোগান্তি হইলাম কীজন্য?
: ঘঁষামাজায় সমস্যা কী? এতে কি আপনের সার্টিফিকেটের ওজন কমে যাবে? আর ভোগান্তিরে ভোগান্তি মনে করতেছেন কেন? এখন হইল আপনেদের শেখার বয়স। এই বয়সে ভ্যারাইটিজ কিসিমের অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়া সামনে দিকে অগ্রসর হইলে লাইফের পররবর্তী স্টেজে তা কাজে লাগবে।
: আমি ফ্রেশ জিনিস চাই।
: তাইলে আপনাকে আবার সবকিছু প্রথম থেইকা নতুনভাবে শুরু করতে হবে...
মাসকাত এসএসসি পাস করেছিল ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৩ সালে দেশের সরকারি একটি দফতর তার নাম নিয়ে যে ধরনের সমস্যা তৈরি করেছিল, ২০২২ সালে অন্য একটি সরকারি দফতর আমার নাম নিয়ে একই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৩ থেকে ২০২২। মাঝখানে অনেকটা সময়। এ সময়কালে বিশ্বের অনেককিছু বদলে গেছে। বাংলাদেশেও অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। আফসোস! পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না কেবল সরকারি অফিসগুলোর কাজকর্মে।
লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক ।
[email protected]
এইচআর/জিকেএস