পালিত শিশুর অভিভাবকত্ব বনাম দত্তক
ইয়াহিয়া নয়ন
নিঃসন্তান দম্পতি অন্যের সন্তানকে লালন পালনের জন্য নিয়ে থাকেন। সেই শিশুকে লালন পালনের মাধ্যমে তারা শিশুটির অভিভাবক হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সন্তান বড় হয়ে তার পালিত বাবা মায়ের সম্পদের ভাগিদার হতে পারেন না। দেশের সংবিধান এক্ষেত্রে বাধা। বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় হয়েছে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আইনি জটিলতাটি মূলত উত্তরাধিকার প্রশ্নে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিভাবকত্ব পেলেও একটি শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে কিন্তু পালক নেয়া বাবা-মায়ের কোন সম্পত্তি পায় না। কেননা বাংলাদেশে ইসলামী আইনের অনুসরণ করা হয় এবং মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে আদালত শুধু সন্তানের অভিভাবক হবার অনুমতি দেয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের একজন পরিচালক ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ আল-মারুফ বলছিলেন, ইসলামী আইনের আলোকে পালিত শিশু পালক পিতামাতার সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে না। সে ওই বাবা-মায়ের নামও ব্যবহার করতে পারবে না। তবে তারা পালক সন্তানকে সম্পত্তি দান করে দিতে পারেন বা ওয়াসিয়ত করতে পারেন।
দান কিংবা ওয়াসিয়ত করা গেলেও এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে অনেক পরিবারে। একদিকে নিঃসন্তান দম্পতিরা চাইলেও পালিত সন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার করতে পারেন না। অন্যদিকে সম্পত্তির অধিকার থেকে পালিত সন্তানও বঞ্চিত হয়।
পালক নেয়া বাবা মায়ের মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়রা এসে যদি সম্পত্তি থেকে ওই সন্তানকে বঞ্চিত করে, তাহলে কিন্তু আইনত তার কিছুই করার থাকে না। এটা একটি বিরাট সমস্যা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের গর্ভে জন্ম হওয়া শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাদের দত্তক দিতে ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শিশুপাচার বা ধর্মান্তরিত হবার ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালে সরকার আইনটি বাতিল করে।
ফলে দত্তক যেমন নেয়া যায় না, তেমনি কোন বিদেশি নাগরিকও বাংলাদেশের কোন শিশুর অভিভাবক হতে পারে না। তাছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের প্রথম দিকের স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও শিশু দত্তক নেয়ার ধারাটি অনুস্বাক্ষর করেনি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দত্তক সন্তান প্রাকৃতিক সন্তানের মতো উত্তরাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তবে বাংলাদেশে ধর্ম ভেদে ভিন্ন নিয়ম রয়েছে। তবে ১৯৮২ সালে দত্তক নেয়ার আইন বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত বহু পরিত্যক্ত শিশুকে এই আইনের আওতায় দত্তক দেয়া হয়েছিল। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই দত্তক মানেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক সন্তানের মতো উত্তরাধিকার পাবার যোগ্য হয়।
বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে আছে। বর্তমান জনবান্ধব সরকার জনকল্যাণে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে হাত দেয়নি। বিধবা, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, অসচ্ছল, নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সহায়তা করে সারা বিশ্বে সুনাম করেছে। আর অনাথ এতিম অজ্ঞাত বাবা মায়ের সন্তানরা যাদের আদর যত্নে মানুষ হবে তাদের সম্পদের অধিকারী কেন হতে পারবে না ? এই মুজিববর্ষে এসে এই বিষয়ে ১৯৭২ সালের সেই আইনটির পরিমার্জন করা সচেতন নাগরিকদের চাওয়া।
তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে গত বছর আইন কমিশন থেকে পৃথক একটি দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এখন সরকারের দিক থেকে এ নিয়ে একটি বিধি প্রণয়নের কথাও ভাবা হচ্ছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসিমা বেগম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বর্তমানে শিশু আইনের আওতায় বিকল্প যত্ন বা পরিচর্যার নীতির আলোকে তারা এই বিধি করতে যাচ্ছেন।
দিন কয়েক আগে পত্রিকার পাতায় পড়লাম, একজন জেলা প্রশাসক আপাত পরিত্যক্ত এক মেয়েশিশুর লালনপালনের দায়িত্ব নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে তিনি মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। তার নিজের একটি মেয়েসন্তান আছে। আশা করা যায়, তার পরিবারে অন্তর্ভুক্ত শিশুটি ভালো থাকবে এবং বিকাশের সুযোগ পাবে। জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্রপত্রিকায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অনেকে। তিনি নিশ্চয় শুভেচ্ছার যোগ্য কাজ করেছেন।
বেশির ভাগ কাগজে অনলাইনে লেখা হয়েছে জেলা প্রশাসক দত্তক নিয়েছেন। সেটাই প্রচারিত হয়েছে সর্বত্র। প্রকৃত পক্ষে জেলা প্রশাসকের আনুষ্ঠানিক আরজির পরিপ্রেক্ষিতে জেলাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাকে শিশুটির অভিভাবকত্ব প্রদান করেছেন। অভিভাবকত্ব আর দত্তক এক বিষয় নয়। এই শিশু বড় হয়ে তার পালিত বাবা মায়ের সম্পদের ভাগিদার হতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে সে অনাথই থেকে যাবে।
পালক বাবা মায়ের মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়রা এসে যদি সম্পত্তি থেকে ওই সন্তানকে বঞ্চিত করেন, তাহলে আইনত তার কিছুই করার থাকে না। মূলত সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নেই সমস্যা শুরু হয়। দান কিংবা অসিয়ত করা গেলেও এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নেই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে অনেক পরিবারে। ১৯৭২ সালের বিশেষ আইন শিশুদের পক্ষে ছিল। আশা করি মুজিব শতবর্ষে এসব শিশুর অধিকার রক্ষায় নতুন কিছু হবে।
সম্ভবত ২০১৩ সালে আইন কমিশন পৃথক একটি দত্তক আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করেছিল। জানা গিয়েছিল সরকারও এ বিষয়ে একটি বিধি প্রণয়নের কথা ভাবছিল। সে সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ছিলেন নাছিমা বেগম, (বর্তমানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান)। তখন তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে শিশু আইনের আওতায় বিকল্প যত্ন বা পরিচর্যার নীতির আলোকে তারা এই বিধি করতে যাচ্ছেন। বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি, শিশু নিবাসের চাইতে একটি পরিবারে মা-বাবার আদরে একটি শিশু বড় হলে তা ভালো হবে। তাই আমরা বিষয়গুলো সহজ করার কথা ভাবছি।’
তারপর কি কিছু করা হয়েছে? পালিত শিশুরা সন্তানের মর্যাদা ও অধিকার পাবে এমন আইনি ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এটাই এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/জিকেএস