রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংহত করেছেন শেখ হাসিনা
সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার টানা দায়িত্ব পালনের ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ৭ জানুয়ারি। বাংলাদেশের জন্য এটা একটি রেকর্ড। পরপর টানা তিন মেয়াদে এবং মোট চারবার প্রধানমন্ত্রী থাকার রেকর্ড কেবল শেখ হাসিনারই আছে। তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১৪ সালে তৃতীয়বার এবং ২০১৯ সালে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। শেখ হাসিনার আগে বাংলাদেশে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি।
শেখ হাসিনার ঝুলিতে আরও অনেক রেকর্ড রয়েছে। দেশের বৃহত্তম এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব তারচেয়ে বেশি সময় আর কেউ পালন করেননি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। তার আগে দশ বছর অবশ্য তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন আর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধিযাত্রা সম্ভব হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবেও সময়ের হিসাবে এগিয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। সরকার পরিচালনায় এবং বিরোধী রাজনীতিতে তিনি তার যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতার সাক্ষর রেখেছেন। তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন প্রবীণ নেতাদের চেয়ে নেতৃত্বগুণে এগিয়ে গিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন, শেখ হাসিনাও তার সময়ের সবাইকে ছাড়িয়ে নিজের নেতৃত্বকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
রাজনীতিতে শেখ হাসিনার চলারপথ ফুল বিছানো ছিল না। তাকে কেউ যেচে জায়গা ছেড়ে দেয়নি। বরং অনেক প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই তাকে এগোতে হয়েছে। কখনও বা তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ শেরপা। বাবা-মা-ভাই-ভ্রাতৃবধূসহসহ অসংখ্য স্বজন হারিয়ে, পদে পদে বিপদ, এমনকি জীবননাশের হুমকি সত্ত্বেও তিনি দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণব্রতী হয়ে বলিষ্ঠভাবে এগিয়েছেন বলেই আজ তিনি দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত হতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতা সব সময় প্রবল। বিরোধিতার রাজনীতি এখানে যতটা প্রভাব ফেলে পক্ষের রাজনীতি ততটা নয়। রাজনীতির এই ক্ষতিকর প্রবণতা এখন কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। শুধু ‘না' বলে মানুষকে মাতানো যায় না, মানুষ ‘হ্যাঁ' শুনতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। রাজনীতির এই গুণগত পরিবর্তন শেখ হাসিনার কৌশলী অবস্থানেরই ফল।
রাজনীতি নিয়ে হতাশা, ক্ষোভ এখনও নেই তা বলা যাবে না। ক্ষমতার রাজনীতি থেকে শুদ্ধতা বিদায় নিয়েছে বলে মনে করা হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলা হলেও দুর্নীতি কমছে না। সুশাসনের অভাব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে। গণতন্ত্র নিয়েও বিতর্ক, প্রশ্ন আছে। নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
তবে দেশের মানুষের অভাব-দুঃখ যে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কমেছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের আগের বাংলাদেশ আর তার শাসনের বাংলাদেশ এক নয়। এক সময় বাংলাদেশ ছিল বড় দেশগুলোর করুণানির্ভর। তলাবিহীন ঝুড়ি। খাদ্য ঘাটতি, ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিত্যসঙ্গী ত্রাণ পাওয়ার আশায় হাত পেতে থাকা একটি দেশ। কিন্তু এখন বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলার মতো মানুষ এখন অনেক আছেন।
শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশ একদিকে যেমন নিরাপদ, অন্যদিকে তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতির উদাহরণ। ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন উন্নত দেশের লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না' তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাওয়ার গল্প তৈরি করছি একের পর এক। কেউ দাবিয়ে রাখতে পারছে না।
শেখ হাসিনাকে অসফল প্রমাণ করার ষড়যন্ত্র কম হয়নি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে সরকার এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার এক বড় ষড়যন্ত্র অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। বিএনপি-জামায়াত শাসনের সময় দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে জঙ্গিবাদী অপশক্তি দেশকে প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার মহড়া দিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার দেশকে জঙ্গিবাদমুক্ত করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। বেশ কয়েকটি সফল অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিদের গোপন আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিচ্ছে না।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সরকারবিরোধিতার নামে সহিংতার বিস্তার ঘটিয়ে মামুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা একাধিকবার করেছে। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দমনে সরকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সক্ষম হয়েছে। এরপর ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং পরের বছর সরকার পতনের ডাক দিয়ে দেশজুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। আগুনসন্ত্রাস ছড়িয়ে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। মানুষের মনে তৈরি হয়েছিল আতঙ্ক।
সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। গণতন্ত্রের সুযোগের অপব্যহার করে সন্ত্রাস-সহিংসতার পথে হেঁটে বিএনপি ও তার সহযেগীরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এখন রাজনীতিতে খাবি খাচ্ছে । একের পর এক ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিএনপি নামের দলটিকে এখন অস্তিস্ত সংকটের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। আর শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কৌশল এবং ব্যক্তিগত সাহসিকতা দিয়ে পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখতে পেরেছেন।
শুধু রাজনৈতিকভাবেই দেশকে শেখ হাসিনা সংহত অবস্থানে এনেছেন, তা নয়। অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ এখন শক্ত অবস্থানে আছে। করোনা মহামারির কারণে পৃথিবীব্যাপী বড় সংকট তৈরি হয়েছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশগুলো করোনায় কাতরাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনাকালেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির আগাম অভিযোগ এনে অর্থসহায়তা না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যারা বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিল, তারা এখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে এক নতুন সক্ষম বাংলাদেশকে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে অনেকেই মনে করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস দেখিয়েছেন। পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্নকল্পনা নয়। দৃশ্যমান সত্য। বাংলাদেশ যে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে গৌরবের সমাচার হয়ে উঠেছে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু ছাড়াও মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, ঢাকা এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। ঈশ্বরদীতে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজও বন্ধ নেই। কক্সবাজারের মাতারবাড়ি এবং পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। এসব প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির নতুন সোপানে উন্নীত হবে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কাজগুলো হতে পেরেছে শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও বলিষ্ঠতার কারণেই। শেখ হাসিনার এই এক যুগেই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সন্দেহ-অবিশ্বাস দূর হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে থাকা সিটমহল সমস্যার সম্মানজনক নিষ্পত্তি হয়েছে। সমুদ্রসীমার বিরোধ মিটেছে আন্তর্জাতিক আদালতে। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ক্রমঅগ্রসরমানতা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। দিনবদলের সনদ রূপকল্প ২০২১- এরপর ২০২১ থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন এবং দেশের মানুষের সামনেও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন তুলে ধরেন। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হবে। ৫০ বছরে যেসব অপ্রাপ্তি রয়েছে, যা না পাওয়ার বেদনা আছে, তা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ বছর নতুন আলো ছড়াবে– এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।
করোনা মহামারি অবশ্যই কিছুটা বাধা হয়ে এসেছে। তবে সব বাধা অতিক্রমের সাহস যুগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শাসনের এক যুগ পূর্ণ করেছেন। করোনাকালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নতুন রেকর্ডে পৌঁছেছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও যথাসময়ে নতুন বই পৌঁছে গেছে শিক্ষার্থীদের হাতে।
দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটের ঘটনা দেশে ঘটছে না, তা নয়। বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও বাড়ছে। তবে লুটপাটের কাহিনি কি এই এক যুগে, নাকি এর ধারাবাহিকতা আছে? শেখ হাসিনা সব সময় সব কিছু তার মতো করে করতে পারেন, তা-ও হয়তো নয়। দুনিয়ার কোনো দেশেই রাজনীতি একটি সরলরেখা ধরে চলে না। সরকার এবং সরকারের বিরোধিতা হলো রাজনীতির চিরায়ত খেলা। দ্বন্দ্ব-বিরোধ রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা। যে রাজনীতি বেশি মানুষের উপকার নিশ্চিত করে, সে রাজনীতিই টেকসই হয়। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে শেখ হাসিনার সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন। তার এই চেষ্টা অসফল হতে পারে না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক । সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/জিকেএস