মনের ঘরে ঘুণের বাস


প্রকাশিত: ০২:৪৪ এএম, ০৪ জানুয়ারি ২০১৬

নীলা। বয়স ১৭। সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। রেজাল্ট ভাল হবার আশা করছে সকলেই, কিন্তু নীলা জানে পাস করতে পারলেই তার জন্য যথেষ্ট। বাবা-মায়ের আকাঙ্খার সাথে বাস্তবতার যে কোথাও কোনো মিল নেই কিংবা হবে না তাও নীলা ঢের বুঝতে পারে। সময় গড়িয়ে এক সময় রেজাল্ট বের হয় এবং যথারীতি অতি সাধারণ মানের ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয় নীলা। এরই ধারাবাহিকতায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাক্ষর না রাখতে পারায় তার ঠাঁই হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এটুকু পর্যন্ত নীলার জীবন মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এরপরেই শুরু হয় মায়ের বকুনি, বাবার বিরক্তি, প্রতিনিয়ত শুনতে হয় বহু অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের হেতু। পাশাপাশি মেধার অযোগ্যতার সাথে যুক্ত হয় “এ মেয়ে ঘরে রাখার চেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়াই শ্রেয়”- জাতীয় কথাবার্তা। অন্যদিকে গায়ের রংটি একটু চাপা বলে বিয়েতেও নাকি যথেষ্ট ভোগান্তি হবে বলে আশংকার পূর্বাভাষ।

সবকিছু মিলিয়ে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হতে শুরু করে নীলা। বেঁচে থাকাটি দিনদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। মৃত্যুই যেন সহজ সমাধান- এ বোধ গ্রাস করে চরম  হতাশাগ্রস্থ নীলাকে।  আর তারই ফলস্বরুপ প্রথম প্রয়াস চালায় আত্মহননের। এক রাতে গোটা বিশেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলে নীলা। কিন্তু অতিরিক্ত পানি পানের দরুন এক পর্যায়ে বমি হয়ে যায় তার। এরপর প্রায় দুদিন নিস্তেজ থাকে সে, কিন্তু কোনোকিছুই টের পায় না বাড়ির লোকেরা।

এই ঘটনার মাস খানেক পরের কথা। মেয়েকে পাত্র পক্ষের সামনে ফর্সা উপস্থাপনের অপচেষ্টায় লিপ্ত মায়ের নিজের হাতে সাদা পাউডার মাখিয়ে ‘সঙ’ সাজানোর অপমান সহ্য করতে পারে না নীলা। এরপর পাত্র পক্ষের নায়ের গ্লানিতে হিতাহিত জ্ঞান হারায় নীলা। টেবিলের ওপর রাখা ধারালো ছুরি দিয়ে হাতের কব্জির রগ কেটে ফেলে। ফিনকি দিয়ে যখন রক্ত ছুটে তখন একরকম সম্বিত ফিরে পায় নীলা এবং বাঁচার আকুতিতে আছড়ে পরে আপনজনের সামনে।

আত্মার বসবাস যে দেহ নামক কুঠুরিতে, সেই দেহকে স্বেচ্ছায় (?) স্ব-উদ্যোগে হত্যার নামই আত্মহত্যা। এ কেবল নিজেকে হত্যা নয় বরং আত্মারও হত্যা। কিন্তু আত্মা কী? ধর্ম একে বহুরুপে সজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছে বৈকি কিন্তু ফ্রয়েডিয় ভাবনায় মন আর আত্মা অভিন্ন এবং অনন্য।

আত্মহত্যার আত্মপ্রকাশ কোনো সাম্প্রতিক কিংবা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই ঘটনা জন্ম নিয়েছে মানবকুলে। কিন্তু সমাজ ভেদে সময়ের বহতা স্রোতে এর আঙ্গিক বদলেছে, কখনো বদলেছে আত্মহননের ধরন। আর সে কারণেই যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন অনুসন্ধানী ধারা আত্মহত্যাকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে তাদের নিজস্ব সত্বার আলোকে। কখনো সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে, কখনো বা দর্শন বিদ্যার আলোকে, আবার কখনো মনস্তত্ত্ব, ধর্ম, অথবা বিজ্ঞানের যুক্তিতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে আত্মহত্যার ‘আত্ম’কে। কিন্তু ব্যাখ্যা যা-ই  হোক না কেন ফলাফল একটি মৃত্যু।

একটি মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই নির্মিত অথবা পরিচালিত হয় পরিবারের বুনিয়াদি উপাদান দ্বারা। জন্ম থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পরিবার পরিজনের সমর্থনই ব্যক্তির পথ পরিক্রমার সবলতা/দুর্বলতা, দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা/ দুর্বল ও পরাধীনতা এমনকি ব্যক্তির যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার মানসিক শক্তি বিনির্মাণে সাহায্য করে।

পরম নিরাপদ আশ্রয় পরিবার যখন ব্যক্তিকে আর প্রকৃত অর্থে ধারন করতে পারে না, তখনই ব্যক্তির মানসপটে বিচিত্র মিথস্ক্রিয়া ঘটে এবং যার পরিণতিতে কখনো ব্যক্তি জীবনকে অর্থহীন ভাবে এবং মৃত্যুই তার কাছে অধিক কাম্য হয়ে ওঠে। আর এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই মানুষ বেছে নেয় আত্মহননের পথ, কখনো সফল হয় আবার কখনো প্রকৃতির কৃপায় রক্ষা পায়।

আভিধানিক অর্থে যদিও বলা হয়ে থাকে ‘সচেতনভাবে’ নিজেকে হত্যা এবং এটি সর্বজন দ্বারা স্বীকৃত হলেও  প্রশ্ন ওঠে ‘সচেতন’ শব্দটি নিয়ে। কারণ, আত্মহত্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়,  শতকরা ৯০ জনেরও অধিক ব্যক্তি, যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়,  মৃত্যুকালে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ্য থাকে। আর একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে অসুস্থ্য থাকাকালে কি করে সচেতনভাবে নিজেকে হত্যার  সিদ্ধান্ত নেয়-বিষয়টি বিভ্রান্তির অবতারণা ঘটায়। বরং সচেতন শব্দটির পরিবর্তে ‘স্বেচ্ছা’ শব্দটি অনেক বেশি যথাযথ হতে পারে।

 নীলার ঘটনা বিশ্লেষণে প্রধানত তিনটি পারিবারিক নিয়ামক স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, পারিবারিক বন্ধনে শৈথিল্য: যখনই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সাথে সম্পর্কগুলোতে শীতলতা চলে আসে অথবা যথা নিয়মে সম্পর্ক গতিশীল থাকা সত্ত্বেও কোনোকরম বন্ধন অনুভব না করে, তখন ব্যক্তির মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় যে কারণটি দেখা যায়, কাছের মানুষ কিংবা আপনজনের নিকট থেকে কোনোরুপ রুঢ় আচরণ এবং তা বারংবার পুনরাবৃত্তি। কাঙ্খিত আচরণের বাইরে কোনো ব্যবহার যদি ব্যক্তিকে গ্রহণ করতে হয় তখনই ব্যক্তির অহংবোধ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আর যদি তা মনের তিন উপাদান তথা ইড, ইগো এবং সুপার ইগো দ্বারা সমন্বয় সাধন করে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনা না যায় তবে ব্যক্তির ইড শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং অপর দুই উপাদানের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। যার ফলশ্রুতিতে ব্যক্তির বিবেক, বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা, ন্যায় অন্যায় জ্ঞান, যৌক্তিকতার ধারণা হ্রাস পায় এবং কখনো বিচার বুদ্ধিহীনভাবে আত্মহত্যাকে কষ্ট থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথ ভাবতে শুরু করে।

এছাড়া তৃতীয় যে উপাদানটি ওঠে আসে তাহলো ব্যক্তির বৈরি পরিবেশ। এই উপাদানটিও যথেষ্ট মাত্রায় দ্বিতীয় উপাদানের ব্যাখ্যার সাথে যায়। এছাড়া এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ব্যক্তির নির্ভরতার ধরন, পরিবার ও বন্ধু বান্ধবের সমর্থন এবং তাদের সাথে সম্পর্কের ধরন ও মাত্রাও এ বিষয়টি মোকাবেলায় বিবেচ্য হয়ে ওঠে।

মানসিক উপাদানের ক্ষেত্রে হীনমন্যতা ব্যক্তিকে কখনো জেদি একরোখা কিংবা অভিমানীও করে তুলতে পারে। পাশাপাশি নিজেকে ভালোবাসতে না পারার কারণে জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়। কখনো প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে অথবা কাছের মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আত্মহত্যার পথকে বেছে নেয় ব্যক্তি। কিন্তু মনের এমন বৈকল্য কেবল নিজেরই ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি।

সাইকোলজি টুডে নামক একটি অনলাইন পত্রিকায় অাত্মহত্যার ছয়টি সাধারণ কারণকে সনাক্ত করা হয়েছে। মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্য আত্মহত্যার পথকে বেছে নেয়ার সময় সেসকল ব্যক্তিরা মূলত/সাধারণত-

১. চরম বিষন্নতায় ভোগেন
২. মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত থাকেন
৩. অস্বাভাবিক অস্থিরতায় ভোগেন
৪. ভীষণভাবে সাহায্য প্রার্থনা করেন কিন্তু অন্যকে বোঝাতে পারেন না
৫. দার্শনিকভাবে/দর্শনগত কারণে মৃত্যুকাঙ্খী এবং
৬. জীবনে বড় রকমের কোনো ভুল থাকে, যার জন্য অনুতপ্ত হয়ে মৃত্যুকে বাঞ্ছনীয় ভাবেন।

উল্লেখিত ছয়টি কারণের প্রত্যেকটির পিছনেই করে জীবনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, হতাশা কিংবা মানসিক আঘাত। গবেষণায় দেখা যায় ৯০ শতাংশেরও অধিক ব্যক্তি আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল এবং সবচেয়ে সাধারণ মানসিক রোগের ধরন হচ্ছে বিষন্নতা।

সামাজিক, পারিবারিক এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও মানসিক রোগ সর্বদা অবহেলিত এবং অগ্রাহ্য হয়ে থাকে বিধায় এই মানসিক রোগ যে কখন মরণব্যাধিতে পরিণত হয় তা লক্ষ্যই করা হয় না, আর সকলের অগোচরে ডিপ্রেসন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া এবং আরো বহু মানসিক রোগ জেঁকে বসে ব্যক্তির মানসপটে আর পরিণামে কখনো মৃত্যু ঘটে মূল্যবান জীবনের।

সকলের মনে রাখা উচিত যে বহু সামাজিক উপাদান ব্যক্তির জীবন বিকাশের সহায়ক নাও হতে পারে। সামাজিক ট্যাবু কখনো জীবনকে করে তুলতে পারে জটিল দুর্বিষহ। কিন্তু তাই বলে হার মানলে চলবে না। নিজেকে ভালবাসলে অন্যকে ভালবাসা সম্ভব আর নিজেকে চিনতে পারলেই জগৎকে চেনা সম্ভব। ব্যক্তির সাহসী পদচারণা ও সমাজকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ার প্রত্যয়ই পারে সমাজকে বদলে দিতে।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।