বিএনপির থলের ভেতর পাকিস্তানি দৈত্য
মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপার্সন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছেন। শহীদের সংখ্যা নিয়ে তার এরূপ প্রশ্ন ও ‘কুতর্ক’ জাতীয়ভাবে ধীকৃত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। একই সাথে এবং প্রায় একই ধরনের কথবার্তায় আমরা বিগত কয়েকটি বছরে তদীয়পুত্র তারেক রহমানের নানা বক্তব্য-ভাষ্যে গণমাধ্যমকে তপ্ত হতে দেখেছি। এদেশের নানা ধরনের গণমাধ্যম বেগম জিয়ার এসব সংশয়, সন্দেহ ও অনেকাংশে প্রলাপকে ‘বিতর্ক’ বলে প্রচার করছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মীমাংসিত কোনো বিষয়ে সন্দেহ বা সংশয়ের অবকাশ নেই। সম্প্রতি গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যকেও কোনো কোনো গণমাধ্যম ‘বিতর্ক’ বলতে চাইছে। গয়েশ্বরের ধৃষ্টতাপূর্ণ কুরুচিকর ও অশ্লীল বক্তব্যকে ‘বিতর্ক’ আখ্যা না দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি সকল গণমাধ্যমকে অনুরোধ জানাই। আশাকরি, গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট কেউ না কেউ সচেতন ও সংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গয়েশ্বরের বক্তব্য আসলে একেবারেই অসুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন এবং অবিবেচনাপ্রসূত। মানসিক বিকারগ্রস্ততা কিংবা শারীরিকভাবে চূড়ান্ত অসুস্থতা ছাড়া কোনো চিন্তাশীল সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে মহান স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং এদেশের জাতীয় বীরদের নিয়ে অশালীন এরূপ বক্তব্য প্রদান অসম্ভব। কী মাত্রার অসুস্থতা থাকলে, কী মাত্রার বিকারগ্রস্ততা থাকলে, কী মাত্রার ইতরবিশেষ প্রাণি হলে একজন মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব যে, ‘পাকিস্তানিদের বেতন খাইছে, শেষ দিন পর্যন্ত, তারা নির্বোধের মতো মারা গেল, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়। ওনারা যদি এত বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকে কী করে, একটু বলেন তো। আর তাছাড়া নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রতিমাসে পাকিস্তানের বেতন খাইল, এটাও তো কথা বলা যায়, যায় না? পাকিস্তান সরকারের বেতন খাইল, তারা হয়া গেল মুক্তিযোদ্ধা, আর যারা পালায়ে পালায়ে না খেয়ে বেড়াল তারা হয়া গেল রাজাকার, তাই না?’ ‘পাকিস্তানের বেতন খাইল’ গয়েশ্বরের এরকম কথা শোনে মনে হচ্ছে সে বেতন ছিল তার ব্যক্তিগত কিংবা পৈতৃক সম্পদের অর্থে প্রদত্ত। প্রকৃত অর্থেই তাই। কারণ যারা পাকিস্তানকেই মনে-প্রাণে ধ্যান-জ্ঞান করে তাদের কাছে এরূপ মনে হওয়া স্বাভাবিক। আর বারবার এসব স্বাভাবিকতাই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে বিএনপির ঘাঁটছড়া কত গভীরতর। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের সময়ও আমরা দেখেছি পাকিস্তান ও বিএনপির প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ব্যবধান একেবারেই শূন্যের কোঠায় থাকে। সুতরাং ‘তাহাদের প্রকৃত পরিচয়’ প্রকাশিত হচ্ছে ধীরে ধীরে একথা বলা যায়।
আমরা দেখছি বিগত কয়েকটি বছর ধরে সামগ্রিকভাবে বিএনপি রাজনৈতিকভাবেই এই বিকারগ্রস্ততার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এই ধারায় সর্বশেষ যুক্ত হলো গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। শোভন ও শালীনতার সকল সীমা লঙ্ঘন করে এদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এবং তাদের শহীদ হওয়া নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ‘ইতরবিশেষ’। তাদের এসব কথা বক্তব্য বিবৃতি শোনে এখন আমাদের বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থানকারী কোনো রাজনৈতিক দল। তাহলে কি আমরা ধরে নেবো যে, বিগত কয়েক বছরে তারেক রহমানের বক্তব্যসহ সাম্প্রতিককালের বেগম জিয়া কিংবা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্যই আসলে বিএনপির ‘অফিসিয়াল’ বক্তব্য? যদি গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সেদিন শারীরিকভাবে সুস্থ থেকে এরূপ বক্তব্য প্রদান করে থাকেন তবে তো একথা মানতেই হবে যে, তার সেদিনের সেই বক্তব্যও প্রকৃতপক্ষে বিএনপির ‘অফিসিয়াল’ বক্তব্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তার শারীরিক সুস্থতার প্রমাণপত্র জাতির সামনে হাজির করা। কিন্তু সে দায়িত্ব কে নেবে?
আমাদের বিবেচনায় তাকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি সেদিন যা বলেছেন তা ছিল মনের গোপন কথা যা আতিমাত্রায় শারীরিক ‘অসুস্থতা’র জন্য মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে! আর যদি সে পরীক্ষায় আমরা দেখি যে, তিনি সুস্থ অবস্থায় এবং সজ্ঞানে এদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের উদ্দেশ্যে সেসব কথা বলেছেন তাহলে এটা যে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল তা অনায়াসে প্রমাণ হয়ে যায়। আর একথা প্রমাণ হলে দেশবাসীর বুঝতে বাকি থাকে না যে, যত শ্বেতশুভ্র বহিরাবরণ হোক না কেন ক্রমেই বিএনপির আসল রূপটি প্রকাশ পাচ্ছে। মুখে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার কথা বললেও ভেতরে ভেতরে তারা যে পাকিস্তানি আদর্শ ও অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নবাদী রাজনীতিবিদ তাও হয়তো সহসাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে যখন কূটনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটা অনাকাক্ষিত সময় অতিক্রম করছে তখন বিএনপির ওপর মহল থেকে পর্যায়ক্রমে যে সব বক্তব্য বিবৃতি আসছে তাতে একথা সত্য যে, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরো গাঢ়তর হবে। পাকিস্তানও চায় বাংলাদেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত থেকে উন্নয়নের ধাবমান স্রোতধারা থেকে পিছিয়ে পড়ুক। কারণ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামাজিক উন্নয়নের অনেক সূচকে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ‘এগিয়ে যাওয়ায়’ সাধারণের মনে একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়েছে তেমনি অন্যদিকে আরো বড় ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হয়ে ততোধিক বড় বড় সাফল্য অর্জনে মানসিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে। এই এগিয়ে যাওয়ার স্রোতধারা থেকে বিএনপি বঞ্চিত বিধায় উস্কানিমূলক নানা বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করছে। অন্যদিকে পেছনে পড়ার মর্মযাতনা শেয়ার করার জন্য নিঃসঙ্গ পাকিস্তানের যে সঙ্গী দরকার তা পূরণ করে যাচ্ছে বিএনপি। কিন্তু ইতিহাস সচেতন ও স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি পাকিস্তান ও বিএনপির কৌশল বুঝতে পারবে না তা হতে পারে না। সকলেই বুঝতে সক্ষম বিএনপির থলের ভেতর লুকিয়ে আছে মস্ত এক পাকিস্তানি দৈত্য।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/এমএস