ডেমোক্রেসি রিডিফাইন্ড

ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্যোগে ওয়াশিংটনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর শতাধিক দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা এই সম্মেলনে যোগদান করতে যাচ্ছেন। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করাই জো বাইডেনের এ সম্মেলনের লক্ষ্য বলে গণমাধ্যমে জানা যাচ্ছে।

আরও যা জানা যাচ্ছে তা হলো সম্মেলনটিতে আমন্ত্রিতদের তালিকায় পাকিস্তানের নাম থাকলেও, বাংলাদেশের নেই। ‘ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল’ ব্র্যান্ডিংয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে তাদের গণতন্ত্রের ঢোল বরাবরই বাজিয়ে আসছে। এটা নতুন কিছু নয়। তাদের প্রয়োজনে তারা যে কোনো কাউকে যেমন গণতান্ত্রিক বলে সার্টিফিকেট দিতে পারে তেমনি তা পছন্দ না হলে কেড়েও নিতে পারে যে কোনো কারও কাছ থেকেই।

শুধু তাই নয়, এসব যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে গণতন্ত্রের দাবিদার এই মার্কিনিদের হাতে ধরাশায়ী হয়েছেন বিশ্বজুড়ে অসংখ্য দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য অথবা দক্ষিণ এশিয়া প্রতিটি অঞ্চলই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ডেমোক্রেটিক হিপোক্রেসির রক্তাক্ত লিগেসি বহন করে চলেছে। কিন্তু বছরের শুরুতে হাজার খানেক ক্ষ্যাপা সাদা মানুষের তাণ্ডবে যখন ওয়াশিংটনের ক্যাপিটলে মার্কিন ডেমোক্রেটিক ঐতিহ্য প্রায় মুখ থুবড়ে পড়তে বসেছিল, তখন বিশ্ববাসী হঠাৎই বুঝতে পারলো যে নিজ দেশেও ডেমোক্রেসির মার্কিন বটবৃক্ষটি আকারে বড়সড় হলেও, তার নিচে যেমন জঞ্জাল, তার শেকড়ও তেমনি মাটির তলায় খুব বেশি দূর যেতে পারেনি।

দুই.
দুদিন আগেই চলে গেল ১২ নভেম্বর। ১৯৯৬ সালের এই দিনে বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি রিপিল বিলটি পাস হয়। এর মধ্য দিয়েই জাতির জনকের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বিচারের রুদ্ধ দুয়ারটি খুলে যায়। পঁচাত্তরে খন্দকার মোশতাক প্রথমে একটি অর্ডিনেন্স জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি প্রদান করে, যা পরে জেনারেল জিয়ার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংসদ পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে আইনগত বৈধতা পায়। এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের তথাকথিত প্রবক্তা এই জেনারেল সাহেব এভাবেই জাতির জনকের খুনিদের বিচারের পথটি রুদ্ধ করে দিয়ে এদেশে গণতন্ত্রকে একটা শক্ত-পোক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এর পরিণতিতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ‘মিনি পাকিস্তানীকরণ’ প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হয়েছিল, তেমনি এতে জেনারেল জিয়ার হাতে গড়া সংগঠন বিএনপির কি লাভ হয়েছে তাও এক স্রষ্টাই ভালো বলতে পারবেন।

ইনডেমনিটির বাংলাদেশের ইতিহাস শুধুই পিছনে ছুটে চলা আর দল হিসেবে এর পরিণতিতে বিএনপির আজ ঠাঁই হয়েছে কিছুটা জামায়াতের কোচড়ে আর কিছুটা ভাগাড়ে।

তিন.
চুয়াত্তরে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বাকশালের শাসন প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যখন সিরাজ সিকদাররা দেশকে অশান্ত করতে একের পর এক নাশকতা চালাচ্ছে, কমরেড আব্দুল হক অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছে ভুট্টোর কাছে কিংবা জাসদের ক্যাডাররা সারাদেশে তাণ্ডব চালানোর পাশাপাশি হামলা চালাচ্ছে ভারতীয় দূতাবাসেও, আর যখন জ্বলছে একের পর এক পাটের গুদাম কিংবা পিএল-৪৮০ সাহায্য কর্মসূচি গমবোঝাই জাহাজ মার্কিনিরা ফিরিয়ে নিচ্ছে মাঝ সুমুদ্র থেকে অথবা যখন বাসন্তির জালে জড়ানো শরীরের ব্র্যান্ডিং আর মানবসৃষ্ট একের পর এক অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় টালমাটাল সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশ, তখন বাকশালের চাইতে ভালো কোনো সমাধান এদেশের জন্য ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক বিস্তর হতেই পারে, কিন্তু আমার এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

বাকশাল ছিল স্বাধীনতার সপক্ষীয়দের এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে স্বাধীনতার সপক্ষের অন্য দলগুলোর সাথে বিলীন করা হয়েছিল এমনকি আওয়ামী লীগকেও। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়নি বরং প্রকাশিত হতো চারটি জাতীয় দৈনিক। বাকশালের নির্বাচন কাঠামোয় প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। সুবিধা ছিল একটাই আর তা হলো এই প্রার্থীরা সবাই ছিলেন স্বাধীনতার সপক্ষীয়, কাজেই যিনিই হারুক বা জিতুক না কেন, তাতে রাষ্ট্রের এসে যেত সামান্যই।

বাকশালের সমবায়ে যোগ দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু তরুণদের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্যান্টের পা গুটিয়ে আর পায়জামা ছেড়ে লুঙ্গি পরে গ্রামমুখী হওয়ার জন্য। বাকশালের অধীনে প্রাদেশিক কাঠামোয় প্রশাসনকে একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম সেই বাকশালকে তো চেনার সুযোগ পায়ইনি, বরং বাকশালকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল একদলীয় শাসনের সমার্থক হিসেবে। তবে তার চেয়েও যা দুঃখের আর হতাশার তা হলো বাংলাদেশ কখনই একটি দিনের জন্যও বাকশালের অধীনে আসার সুযোগ পায়নি। তার আগেই বঙ্গবন্ধুকে অকালে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

চার.
এভাবেই যুগে যুগে দেশে দেশে ডেমোক্রেসিকে নানাভাবে নিজের সুবিধার জন্য রিডিফাইন করা হয়েছে এবং হচ্ছেও। যে তালেবান ঠেকানোর জন্য আফগানিস্তানে মার্কিনিরা গত ২০ বছরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢাললো, সেই তালেবান সরকারই হাবভাবে মনে হচ্ছে সামনে পাশ্চাত্যের বৈধতা পেতে যাচ্ছে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারে ভালোই জাঁকিয়ে বসেছে সামরিক সরকার অথচ জনগণের ভোটে জেতা বার্থ পার্টির সরকারকে মার্কিনিরা শুধু ইরাকে উৎখাতই করেনি, ফাঁসিতে পর্যন্ত ঝুলিয়েছিল প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে।

পাঁচ.
আমার কাছে ডেমোক্রেসি মানে গরিষ্ঠ দেশপ্রেমিক জনগণের মতামতের প্রতিফলনে এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে শুধু যারা দেশটাকে চেনেন, জানেন, ভালোবাসেন তাদেরই মতামত প্রকাশ আর শাসন করার অধিকার থাকবে। যারা এর বাইরে, যারা দেশটাকে চায়নি বা দেশের প্রতি যাদের আনুগত্য শর্তাধীন, তাদের রোহিঙ্গাদের মতো দেশত্যাগে বাধ্য করা হবে না ঠিকই, কিন্তু তাদের শাসনক্ষমতায় যাওয়া তো দূরে থাক, শাসনক্ষমতায় কে যাবেন সেটুকু নির্ধারণেও কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া যাবে না।

শুধু সে ক্ষেত্রেই জাতি এবং রাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। এদেশের যিনি স্বপ্নদ্রষ্টা, যার হাতে এ দেশের জন্ম, এদেশের নাম থেকে শুরু করে জাতীয় সঙ্গীত, চার জাতীয় মূলনীতি আর সংবিধানটি যার ঠিক করে দেয়া, সেই বঙ্গবন্ধু এ দেশের জন্য যে গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোটি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন তার নাম বাকশাল। আজকের পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাকশালের আক্ষরিক বাস্তবায়ন যে সম্ভব নয় আমিও তা ভালোই বুঝি। কিন্তু স্বাধীনতা সপক্ষীয়দের ক্ষমতায়ন আর পাকাপাকিভাবে ক্ষমতাগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশে আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে কোনো দিনই কোনোরকমের কোনো ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে না, সেটাও আমি মনে প্রাণেই বিশ্বাস করি। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের মতো করে রিডিফাইন করার যার সুযোগটাও এখন আমাদের সামনেই। এতদিন ভালো খারাপ মিলিয়ে যা চলেছে ভালোই চলেছে। এখন ২০২৩-এ গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের মতো করে পাকাপাকিভাবে রিডিফাইন করাটা খুবই জরুরি।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/জিকেএস

স্বাধীনতা সপক্ষীয়দের ক্ষমতায়ন আর পাকাপাকিভাবে ক্ষমতাগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশে আর বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে কোনদিনই কোনরকমের কোন ভিতের উপর দাঁড়াতে পারবে না, সেটাও আমি মনে প্রাণেই বিশ্বাস করি। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের মত করে রিডিফাইন করার যার সুযোগটাও এখন আমাদের সামনেই। এতদিন ভালো খারাপ মিলিয়ে যা চলেছে ভালোই চলেছে। এখন ২০২৩-এ গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের মত করে পাকাপাকিভাবে রিডিফাইন করাটা খুবই জরুরি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।