কত লক্ষ মরলে পরে মানবে তুমি শেষে?
মাননীয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, আপনার ব্যক্তিগত, দলগত, পারিবারিক সমস্ত দোষ ত্রুটিকে পাশ কাটিয়ে একটি বিশেষ দিক আমার কাছে আপনার জন্য একটা আলাদা সম্মানের জায়গা রেখেছিল; সেটি ছিল আপনার বাক্যচয়ন যেটি কখনো শিষ্টতার মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়ে যায় না।
অতি সম্প্রতি আমাদের রক্তস্নাত জন্ম ইতিহাস আর জাতীয় বীরদের প্রতি আপনার চূড়ান্ত অসন্মানজনক প্রশ্ন এবং বক্তব্য শ্রদ্ধার সেই শেষ সুতার টানটাও ছিঁড়ে দিল। ভাবতে কষ্ট হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী আপনি! ধারাবাহিকভাবে আপনার মূল বক্তব্যের প্রবল অসামঞ্জস্যতা গুলো তুলে ধরছি।
প্রথমত: মুক্তিযুদ্ধে ঠিক কতজন শহীদ হলে আপনি মানতেন এটা হানাদার বাহিনীর "অভিভাবকসুলভ শাসন" এর বেশি কিছু হয়েছে ? সংখ্যাটা কত হলে মানবেন ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম, সবচেয়ে কম সময়ে সংঘটিত সর্বাধিক সংখ্যক হত্যাযজ্ঞ এবং ইসলাম ধর্মের অপব্যবহারকারী, ধর্ম ব্যবসায়ীদের নিজ ধর্মে নিজ শাসকের দ্বারা নিজের লোকের উপর সংঘটিত সর্বপ্রথম এই হত্যাযজ্ঞ মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ানক অপরাধ ছিল না?
করাচী লিটারেরি ফেস্টিবল, ২০১২ তে ’৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যার বিতর্ক নিয়ে পাকিস্তানি স্যোশাল সায়েন্স রিসার্চার তাহেরা আব্দুল্লাহর বক্তব্য শুনবেন, মাত্র দেড় মিনিটের ভিডিও। তাঁর বক্তব্যের সারবত্তা ছিল, “ ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের পরিবর্তে ৩ লাখ যারা প্রমাণ করতে চান তাদের কি লাভ? তারা কি মুক্তিযুদ্ধের আত্নত্যাগকে ছোট করতে চান, নাকি পাকিস্তানি আগ্রাসন ও অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের বৈধতা দিতে চান?”
দ্বিতীয়ত: সংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ টানতে হয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রতিটি কন্সান্ট্রেশন সেলে সুনির্দিষ্টভাবে যেসকল ইহুদীদের হত্যা করেছিল তাঁদের নাম, ঠিকানা যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করে রেখেছিল নাৎসি বাহিনী নিজেদের সৌর্য বীর্যের দম্ভ দেখাতে। ভাগ্যের ফেরে যুদ্ধে আকস্মিক ভাবে হেরে যাওয়ায় নাৎসি বাহিনী সেই সব নথিপত্র নিয়মমাফিক ধ্বংস করে যেতে পারেনি যা তাদের জন্য কালসাপ হয়ে পাশবিকতার সাক্ষী দিয়ে গেছে।
এছাড়া বিশ্বের আর সকল যুদ্ধে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ , হতাহত, নিখোঁজ সংখ্যার মতই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধচলাকালীন কোনো নথিকরণ সেভাবে হয়নি। তাই এর ভিত্তি এখন অকাট্য কিছু নেই যুদ্ধপরবর্তী দলিল ছাড়া এবং যুদ্ধের ৪০ বছর পর বিচার কার্যে চাক্ষুস সাক্ষী, অকাট্য নথিপত্র জোগাড় নিঃসন্দেহে সহজসাধ্য নয়।
এরপরেও যদি নির্ভুল সংখ্যা নিরূপণটা আপনার কাছে এতোই গুরত্ব বহন করে তবে শুধু বিএনপি সরকারের ৭৫-৮১, ৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬ - এতোগুলি বছর ক্ষমতায় থাকতেও কেন করেননি ? কেন সেটাও যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি তোলার মতই আওয়ামী সরকারকেই করতে হবে? দেশের প্রতি দায়িত্বের কি অভিনব নিদর্শন আপনার দলের! চমৎকার!
তৃতীয়তঃ বহুল বিতর্কিত “স্বাধীনতা ঘোষণা”। স্বাধীনতার ঘোষণা মেজর জিয়াউর রহমানই দিয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘোষণাটি কি ছিল? প্রথমে ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি ঘোষণা করেন :
“স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি মেজর জিয়াউর রহমান, সরকারের প্রাদেশিক প্রধান, এতদ্দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি.”
(* This is Swadhin Bangla Betar Kendra. I, Major Ziaur Rahman, Provincial Head of the government, do hereby declare that Independence of the People`s Republic of Bangladesh.)
ভ্রান্ত এই ঘোষণার পর একটি দ্বিতীয় ব্রডকাস্ট পড়তে হয়: “আমি, মেজর জিয়াউর রহমান, এতদ্দ্বারা আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি.”
(*On 27 March 1971, a second broadcast was read: I, Major Ziaur Rahman, do hereby declare the Independence of Bangladesh in the name of our great leader Sheikh Mujibur Rahman.)
পরবর্তীতে জার্মান রেডিওর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারেও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার ২৭শে মার্চ ঘোষণাটি সম্পর্কেই বলেন। কারণ, তখন পর্যন্ত একজন সাধারণ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় কোনো উন্মাদও স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্দীপ্ত হবে না এই সামান্য উপলব্ধিটুকু অতি অবশ্যই পরবর্তীতে অন্যতম সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত মেজর জিয়ার বোধগম্যের বাইরে ছিল না। বাঙালি চিনতেন বঙ্গবন্ধুকে, বাংলার অবিসংবাদিত নেতাকে- যার নামেই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, যার নামেই সবাই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যে কেউই এই ঘোষণা দিতেন তাঁকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর নামেই এই ঘোষণা দিতে হতো, মেজর জিয়াকেও তাই দিতে হয়েছে। এই ঘোষণা দিতে পেরে তিনি ধন্য হয়েছেন, যা হতে পারতেন সেই সময়ে জেনারেল ওসমানী কিংবা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখলের কৃতিত্বের অধিকারী মেজর রফিক বা সমসাময়িক কেউই । কিন্তু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের তাতে কোনো হের ফের হতো না।
এবং সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় যে মহান নেতার নামে তিনি সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে তিনি ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন, আজীবন তাঁর দলের সবচেয়ে বড় গর্ব এবং অর্জন , মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ‘৭৫ এ সপরিবারে সেই জাতির জনক শহীদ হবার পর অতি দ্রুত তাঁর নাম তাঁর নামেই জন্ম নেয়া এই দেশ থেকে মুছে ফেলতে এবং তাঁকে কলঙ্কিত করতে তিনি প্রধানতম ভূমিকা পালন করেন। ১৬০০ বন্ধী যুদ্ধাপরাধীকে জিয়ার মুক্তিদানেও যুদ্ধবিধ্বস্ত, সবদিকে বিপর্যস্ত, জনবহুলতার চাপে পিষ্ট একটি জাতি তখন এতো ক্রুদ্ধ অপমানিত হয়নি যতটা ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হয়েছে অন্যতম প্রধান বেইমান স্বাধীনতা বিরোধী শাহ আজীজকে ডেকে নিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রীর আসন কলঙ্কিত করতে; এবং সেই হানাদারদের দোসর নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীন বাংলায় পুনরায় রাজনীতিতে বহাল করাতে। রক্তগঙ্গায় সাতরে অর্জিত স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রযন্ত্রে বসে তারা সব ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল।
আপনিও তাঁরই ধারাবাহিকতায় অন্যতম প্রধান যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে ৯০ এর পর ক্ষমতায় আসীন হয়ে নাগরিকত্ব দেন। চিহ্নিত জঘন্যতম কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্ব দানের সর্বজনবিহিত প্রসঙ্গে নাই বা গেলাম।
তৃতীয়ত: আমরা কখনোই বলছিনা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মানদণ্ডের বাইরে যেই ১৬০০ যুদ্ধ অপরাধী বন্দী ছিল, যাদের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুক্ত করেছিলেন, তারা কেউই ক্ষমার যোগ্য। অবশ্যই জার্মানির নাৎসিদের বিচারের মত হলোকাস্ট আইনে প্রশ্নাতীত ভাবেই সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি এই বাংলায় শেষ দিন পর্যন্ত জাগ্রত থাকবে।
বর্তমানে আলোচিত ১২ জনকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা মূলত একটি “প্রতীকি বিচার” । এর মাধ্যমে এই বার্তা পৌঁছে দেয়া, যে, শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাধর এই আলোচিত ব্যাক্তিদেরও বিচার কার্যকর করা হচ্ছে, কাজেই কেউই এই বিচারের বাইরে নয়। অবশ্যই সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ের কেউ সমানভাবে দায়ী হয়েও দ্রুত বিচারের আওতার বাইরে থাকলে তা বিচার কার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে ।
কিন্তু আপনার দাবি অনুযায়ী রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগে যদি বেশিই থাকতো তাহলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বিএনপি- জামায়াত জোট কোনোদিন চায়নি কেন? আওয়ামী লীগকে কেন নিজের দলের লোকদের বিচার করতে হবে যখন বিএনপি ৭৫-৯৬, ২০০১-২০০৬- এতোগুলি বছর ক্ষমতায় থাকতেও তা করেনি?
আওয়ামী লীগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো পরের প্রশ্ন, বিএনপি -জামায়াত জোট স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীর বিচারটাই বা চাইলো কবে?? "৭১ তো তাদের কাছে "কোনো ইস্যুই না!!
এরপরেও সময় ফুরিয়ে যায়নি। আজকে আপনি-আপনারা করুন না আওয়ামী রাজাকারদের নামে মামলা! ক্ষমতায় তো সারাজীবন আওয়ামী লীগ থাকবে না, অন্য কেউ আসবেই । তখন তাদেরও বিচার করবেন। এখন বিএনপি- জামায়াতের অপরাধী সাফ হোক। দেশ যুদ্ধ অপরাধী মুক্ত হওয়াটাই প্রধান বিবেচ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, ৪ নেতা হত্যা মামলারও ইনশাল্লাহ দ্রুত বিচার হবে। এভাবেই দেশ-জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।
চতুর্থত: জনগণের মেমোরি গোল্ডফিশ মেমোরি, খুব দ্রুতই তারা প্রাপ্তিটা ভুলে যায়, অপ্রাপ্তিই মনে জেগে থাকে। তাই তাদের বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও তারা প্রতি নির্বাচনেই সরকার বদল দেখতে চায়- সে বদলটা যাকে দিয়েই হোক।
আওয়ামী লীগের কোনো ত্রুটির সমালোচনা বা বিরোধিতা অবশ্যই জনগণ করতেই পারবে। কিন্তু ’৭১ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়েই ২০০৮ এর নির্বাচন হয়েছিল- সেই ইস্যুতেই আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। দেশের অগ্রসরতা আপনারা কি করেছিলেন নথিভুক্ত আছে, জনগণ ভুলে গেলেও ইতিহাস কথা বলে।
এর আগেও ’৯৬ এ লীগের শাসনামলে জিডিপি ৭ ছিল যা ২০০১ -২০০৬ এ বিএনপি সরকার আমলে নেমে ৫,৬ এ এসেছিল। ২০০৮ থেকে এতদকালে সংসদ এবং রাজপথে বিরোধীদলের তুমুল বিরোধিতার, বিশৃংখলা সৃষ্টির মাঝেও per capital income দ্বিগুণ, বিদ্যুত উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের মোড়লীপনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জাত্যাভিমানের প্রতীক পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে, দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ে উন্নীত হয়েছে। কাজেই ’৭১ ইস্যু নিয়ে “বিভাজন” এ উন্নতি “ধীরগতি” র যদি এই ফলাফল হয় তবে আমি অন্তত তা মাথা পেতে নিতে রাজি এবং আমার বিশ্বাস বেশির ভাগ বাঙালিই এতে সম্মত হবেন।
আপনাদেরও দিন আসবে, সেদিন নির্বাচনের ইস্তেহারগুলো মনে রাখবেন। নিত্যদিনের জীবন যন্ত্রণায় বাঙালির ক্ষমাশীল আবেগী মন যুদ্ধাপরাধীদেরও প্রায় ভুলতেই বসেছিল। নিজামী, মুজাহিদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ তর্জনী তুলে ক্ষমার অযোগ্য শ্লেষোক্তি “ স্বাধীন বাংলায় ’৭১ কোনো ইস্যু নয়। যুদ্ধাপরাধী বলে কিছু নেই” আমাদের রক্তে আগুন প্রতিরোধ জ্বেলে দিয়েছিল। কাদের মোল্লার জয়সূচক চিহ্ন তাঁকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসির কাঠগড়ায় তুলতে বাধ্য করে। এই ঘটনাগুলি কি এখনো আপনাকে এই বার্তা পৌঁছায় না যে জনগণ যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে বন্ধ করলে বা আবারও এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশ্ন তুললে কবরের মাটি ফুরেও আপনাদের প্রশ্নবিদ্ধ করবে,
" কত লক্ষ মরলে পরে মানবে তুমি শেষে
বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?"
লেখক: কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
এইচআর/এমএস