ইকবাল করলেও অবমাননা হয়!
পবিত্র কোরআন অবমাননাকারীর নাম ইকবাল হোসেন হওয়ায় অনেকে বিপাকে পড়ে গেছেন। ষড়যন্ত্রটা ঠিক জমলো না। নামটা যদি বিশ্বজিত সাহা হতো, তাহলে এ কদিনের তাণ্ডব জায়েজ করা যেতো, নতুন করে হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যেতো।
ইকবাল যে আগুন লাগিয়েছে, তাতে যারা আলু পুড়ে খেতে চেয়েছিল, তারাই একটু বিপাকে পড়েছে। তাতে তাদের যেই জ্বালা সেটা আবার প্রকাশ্য বলেও বেরাচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ বের করতে এতদিন লাগলো কেন, সিসিটিভি সন্দেহভাজনকে ফলো করছে কেন, জুম হচ্ছে কেন, তাকে ধরতে এতদিন লাগছে কেন- এরকম নানা প্রশ্ন আর সন্দেহ দিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা হচ্ছে। যারা জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে অভ্যস্ত, তারাই মনে করছেন, ইকবাল হোসেন আসলে জজ মিয়া, আসল অপরাধীরা আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে।
পবিত্র কোরআন অবমাননায় যারা উত্তেজিত, ক্ষুব্ধ ছিলেন; তারাই এখন ইকবালকে রক্ষায় সন্দেহ তো ছড়িয়ে দিচ্ছেনই; তাকে কখনো ভবঘুরে, কখনো নেশাখোর, কখনো মানসিক ভারসাম্যহীন বলে তার অপরাধ হালকা করার চেষ্টাও হচ্ছে। রামু, নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের ঘটনায় আমার অভিজ্ঞতা বলে ইকবাল হোসেনকে বিচারের প্রক্রিয়ায় খুব বেশি দূর যেতে হবে না। গেলেও সে মানসিক ভারসাম্যহীন ও মাদকাসক্ত এটা প্রমাণ করতে পারলেই মামলা শেষ। এসবই আসলে ইকবালকে বাঁচানোর চেষ্টা।
কিন্তু ইকবালের মা যেখানে সন্তানের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে, সেখানে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা কারা করছে? যারা পবিত্র কোরআন অবমাননার খবরে কিছু না জেনে না বুঝে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালিয়েছে; তারাই। পবিত্র কোরআনের অবমাননা যে কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ক্ষুব্ধ করবে। কিন্তু ক্ষুব্ধ হওয়া আর সেই ক্ষোভের আগুনে ভিন্নধর্মের নিরপরাধ মানুষের বাড়িঘরে হামলা চালানো এক কথা নয়।
কুমিল্লার ঘটনায় চৌমুহনীতে আগুন- কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এটা কীভাবে সম্ভব? এখন দেখা যাচ্ছে, আসলে কোরআন অবমাননাটা বড় ইস্যু নয়, মন্দিরে কোরআন অবমাননা হয়েছে- এই অজুহাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব মাটি করে দেয়া, তাদের ওপর নির্যাতন চালানোটাই মুখ্য। যদি কোরআন অবমাননাটাই ক্ষোভের আসল কারণ হতো, তাহলে ইকবালের বিরুদ্ধেই তাদের মূল ক্ষোভ থাকার কথা। কিন্তু ইকবালের বিরুদ্ধে এই ধর্মান্ধদের কোনো ক্ষোভ নেই, বরং তাকে বাঁচানোর চেষ্টা আছে।
ইকবাল যেমন নিখুঁত পরিকল্পনায় মসজিদ থেকে কোরআন সংগ্রহ করেছে, সেটা মন্দিরে নিয়ে গেছে, পরদিন সকালে আবার বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে, পুলিশের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও নয়দিন যেভাবে পালিয়ে ছিল- তাতে তাকে আমার ঠাণ্ডা মাথার ধূর্ত অপরাধীই মনে হচ্ছে। শুধু ইকবাল নয়, পরদিন ভোরে ৯৯৯ এ ফোন করা ইকরাম, ফেসবুকে লাইভ করা ফয়েজ, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন; পুরো চক্রটার বিরুদ্ধে আমার অনেক ক্ষোভ।
প্রথমত তারা পবিত্র কোরআন করে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আঘাত করেছে। দ্বিতীয়ত ভিন্নধর্মের মানুষের ওপর হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তারা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ধর্মের নামে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দেশজুড়ে যে তাণ্ডব হলো তার দায় তাদেরকে নিতেই হবে। আমি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, কিন্তু আমার ক্ষোভের আগুন নিরপরাধ কাউকে স্পর্শ করবে না। আমি ইকবালের বাড়িতে ঢিলও ছুঁড়বো না। আমি এই চক্রটি এবং যারা তাদেরকে মাঠে নামিয়েছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আশা করছি, ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও ইকবাল গংএর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার থাকবেন। কোরআন অবমাননাটাই যেন মূল ইস্যু হয়; যে করেছে তার ধর্ম পরিচয় যেন অপরাধের কম বেশি না হয়। যে কাজ বিশ্বজিত করলে বিশাল অপরাধ, ইকবাল করলে অপরাধ নয় কেন?
ইকবাল গং চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকে, কোরআন অবমাননার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যাদের নামে মামলা হয়েছে, তাদের মামলা প্রত্যাহার; যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি চেয়েছেন। এমনকি হাজীগঞ্জে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে যে ৫ জন নিহত হয়েছেন তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করছেন। যেন ইকবাল হোসেন কোরআন অবমাননা করলে পুরো ঘটনাটি মুছে ফেলা যায়, ভুলে যাওয়া যায়।
হাজীগঞ্জের ঘটনাটি খুবই বেদনাদায়ক। পুলিশ শুরুতেই ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারতো বা গুলি না চালিয়ে ভিন্ন কোনো উপায়ে তাদের সরিয়ে দিতে পারতো। তবে পুলিশের দাবি, গুলি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। গুলি না করলে আরো প্রাণহানি হতে পারতো। হাজীগঞ্জে নিহতদের পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা। কিন্তু যারা অপরাধী কে না জেনেই চিলের পেছনে দৌড়ে মন্দিরে হামলা করলো, প্রতিমা ভাংলো, হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করলো, আগুন দিলো, লুটপাট করলো; তাদের অপরাধ কিন্তু ফৌজদারি। তাই মামলা প্রত্যাহারের তো প্রশ্নই ওঠে না।
আমি সকল অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। 'কোরআন অবমাননার প্রতিবাদ করতে গেছে' এই বলে এদের অপরাধকে খাটো করার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনের অবমাননার খবর যে কাউকে ক্ষুব্ধ করবে। আপনি প্রতিবাদ করতে রাস্তায়ও নামতে পারেন। কিন্তু ধর্মের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখ্যলঘুদের ওপর হামলা চালানো কোনো কাজের কথা নয়। এতে ইসলামের সবচেয়ে বড় অবমাননা হয়।
অপরাধকে যেন আমরা অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করি; সেটা বিশ্বজিত করলেও অপরাধ, ইকবাল করলেও। কারো বাড়িঘরে হামলা-ভাংচুর-লুটপাট অপরাধ; সেটা যে ধর্মের নামেই হোক না কেন। ধর্ম আমাদের চোখে যে ঠুলি পরিয়ে রেখেছে, সেটা ফেলে দিয়ে আমরা যেন সত্যিকারের ধার্মিক হতে পারি। আমাদের হাতে যেন সব ধর্মের মানুষ নিরাপদ থাকে। আমরা যেন সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখার মত দৃষ্টি অর্জন করি।
২৫ অক্টোবর, ২০২১
এইচআর/জিকেএস