খালেদা জিয়ার অবসর নেওয়ার এখনই সময়


প্রকাশিত: ০৯:০৮ এএম, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫

লেখাটি শুরু করতে চেয়েছিলাম বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে। অনেকদিন পর তাকে অভিনন্দন জানানোর একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। গত ২০ ডিসেম্বর তিনি বলেছিলেন সংঘাত নয়, আন্দোলন নয়, নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারকে ঘায়েল করতে হবে। খালেদা জিয়ার ওই বক্তব্যে আশান্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন আন্দোলনের নামে সংঘাত জনগণের জন্য ভালো কিছুতো  নয়ই বরং দুর্ভোগই বয়ে আনে।  তাকে সাধুবাদ জানাতে চেয়েছিলাম এই কারণে যে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র বৈধ উপায় নির্বাচন, সেটিও তিনি মেনে নিয়েছেন। তার ওই বক্তব্য ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো অনুসরণ করবে সেটাই জনগণ আশা করে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নিন্দাও জানাতে হচ্ছে। এই কলামেই এক সময় লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম বিএনপি একটি যুদ্ধাপরাধীর দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পর্যন্ত  বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আদালতের রায়ে যে ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সর্বোচ্চ সাজা পেয়েছেন তাকে দল থেকে বহিষ্কার না করে  বিএনপি যুদ্ধাপরাধী আশ্রয়দানকারী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আর ২১ ডিসেম্বর বিজয়ের এই মাসে তিনি প্রশ্ন তুললেন শহীদের সংখ্যা নিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দেয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি ষোলকলা পূর্ণ করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদেরই এক অনুষ্ঠানে তিনি বললেন “মুক্তিযুদ্ধ করেছেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা। আজকে বলা হয়, এতো লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কত লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানারকম তথ্য আছে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ না করে খালেদা জিয়া দাবি করেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না।  একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সবাইকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে সত্যিকারে যারা সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করেছিল বিএনপিও তাদের বিচার চায়। কিন্তু সেটি হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্মত, স্বচ্ছ।

জামায়াতীরা সব সময় বলে আসছে দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। গৃহযুদ্ধ হয়েছে। ৭১এ কোনো যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটা শুনলেই জামায়াতিদের গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আর ডিসেম্বর মাস আসলে পাকিস্তানিদের  পরাজয়ের কথা মনে পড়ে যায় বলে উল্টাপাল্টা বলা শুরু করে।  খালেদা জিয়া যেন তাদের কথারই প্রতিধ্বনি করলেন। আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি পাকিস্তানি আর জামায়াতিদের মুখ থেকে ওইরকম কথা শুনতে শুনতে। কিন্তু কখনো ভাবিনি বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়াও এরকম কথা বলতে পারেন। তার প্রয়াত স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমান যিনি বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিদের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছেন। দেশকে আবারো পাকিস্তানি কায়দায় শাসন করার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরেও তিনি কখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বিকৃতি করেননি।

জেনারেল জিয়ার স্ত্রী বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের পাশে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত তাদেরই নেত্রী হয়ে উঠলেন! যে সময় পাকিস্তান বলে যাচ্ছে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ঘটেনি, মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, সেই মুহূর্তে তিনি তাদের সুরেই কথা বললেন! জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান আর তার দলের নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর পাকিস্তানের জামায়াত প্রধান বলেছিলেন, “আজকের দিনটি একটি কালো দিন, কারণ এই দিনে ঢাকায় পাকিস্তানের এক সাচ্চা বন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।” শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে খালেদা জিয়া কী তাদের সাচ্চা বন্ধু হিসেবে নিজেকে আবারো প্রমাণ করতে চাইলেন?

আবারো বলছি এই কারণে যে আমরা যদি খালেদা জিয়ার গত ২৫ বছরের রাজনীতি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই তিনি অতীতে নানা সময় পাকিস্তান আর জামায়াতিদের হয়েই কথা বলেছেন। ১৯৯০ সালে তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে প্রগতিশীলতার কথা বলা হয়েছিল। আর ৯১ সালে তিনি ক্ষমতায় আসলেন জামায়াতেরই হাত ধরে।

বিএনপিরই নেতা মওদুদ আহমদ লিখেছেন সে সময় বিএনপি বামপন্থিদের সমর্থন না নিয়ে কিভাবে জামায়াতিদের সুবিধা দেওয়া যায় সেই চিন্তা করেছেন। ‘বাংলাদেশ এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিমস’ বইয়ে মওদুদ বলেছেন, জেনারেল মোহাম্মদ নুর উদ্দীন খান খালেদা জিয়া ও গোলাম আযমের মধ্যে দূতিয়ালি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর বাসভবনে খালেদা জিয়া, গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে বৈঠক হয়। ৯১ এর নির্বাচনে ১৮ আসনধারী জামায়াত ওই বৈঠকের পর রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে বিএনপিকে সমর্থনের কথা জানিয়ে দেয়। মওদুদ লিখেছেন জামায়াতের আমীর হিসেবে গোলাম আযমের নিয়োগ এবং তার নাগরিকত্ব ফেরত দান ছিল সমঝোতার শর্ত।

এরপর ২০০১ এর নির্বাচনের পর আমরা দেখলাম খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। এর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচার হওয়ায় খালেদা জিয়ার সরকার গণআদালতের ২৪ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও করেছেন। শহীদ জননী সেই মামলা নিয়েই মারা যান।

আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকে খালেদা জিয়া এই বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। কিন্তু তিনি এতটাই জামায়াতি হয়ে উঠবেন তা ভাবা যায়নি। আমার ধারণা খালেদা জিয়ার এমন অবস্থান বিএনপির অধিকাংশ সমর্থকই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজনীতির ক্ষতির পাশাপাশি দলেরও অনেকে বড় ক্ষতি করেছেন।

যেকোনো কিছুরই একটি স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি আছে। ওই স্বাভাবিকতা মেনে না চললে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমার মনে হয়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার স্বাভাবিক সময় হয়ে গেছে....।

pintu
এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।