অটুট থাকুক ধর্মীয় সম্প্রীতি
বুধবার, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের একটি পূজামণ্ডপ থেকে পবিত্র ‘কোরআন উদ্ধার’-ঘটনার পর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা ও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। কোরআন অবমাননার মত এই জঘন্য কাজকে আমরা অবশ্যই নিন্দা জানাই। পবিত্র কোরআনের অবমাননায় প্রতিটি মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ারই কথা। তাই বলে ইসলামের শিক্ষা পরিপন্থী কোন কাজ করার অনুমতিও ইসলাম আমাদের দেয় না। এ জঘন্য কাজটি যে বা যারা করেছে তাদের অতি শীঘ্রই গ্রেফতারেরও আমরা দাবি জানাচ্ছি। ইতিমধ্যে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যে ধর্মেরই হোক না কেন বিচার করা হবে।’ তার এ কথাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। ইতিপূর্বেও আমরা লক্ষ্য করেছি যখনই ধর্মের নামে একটি মহল বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেছে বর্তমান সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে এবং প্রকৃত দোষীদেরকে বিচারের আওতায় এনেছে।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার কোন সুযোগ এখানে নেই। প্রতিটি ধর্মই মানুষের মধ্যে সাম্য, একতা, মানবতা এবং সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে সহাবস্থানে বসবাসের শিক্ষা দেয়। এক ধর্মাবলম্বী অন্য ধমার্বলম্বীকে সম্মান করার আদেশ বিদ্যমান। বাংলাদেশের সংবিধানেও প্রত্যেক ব্যক্তির ধমীর্য় স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ধর্মপালন কিংবা বর্জন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার।
কুমিল্লার ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যে ধর্মেরই হোক না কেন বিচার করা হবে। বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে দুর্গাপূজার চতুর্থ দিনে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপে ভক্তদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সরকারপ্রধান।
কুমিল্লার ঘটনার পরেই ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান বলেছেন, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিমন্ত্রীর বরাত দিয়ে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননা সংক্রান্ত খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। খবরটি খতিয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যে আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। এতে আরও বলা হয়, ‘ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে কেউ এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকলে তাকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। সবাইকে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
একটি অপপ্রচার বা গুজব কত সহজেই যে জনগণের কোন কোন অংশকে উত্তেজিত করে ভয়ংকর কাণ্ড তথা লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে পারে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের দেশেই রয়েছে। যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার রামুতে হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ১২টি বৌদ্ধমন্দির ও ৩০টি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ নামে এক মৎস্যজীবীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনে লোকজনকে খেপিয়ে তুলে ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়।
আমরা প্রায় দেখতে পাই এসব ধর্মীয় উগ্রবাদী ও স্বার্থান্বেষী একটি মহল বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা অপপ্রচার এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং সরকার ও প্রসাশনের ওপর পেশিশক্তি দেখিয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে থাকে। বিশেষ করে দেশে যখন আন্দোলনের কোন ইস্যু থাকে না তখন ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের লক্ষ্যে এরা কখনও ধর্ম অবমাননা বা আহমদিয়াসহ নানা ইস্যু সামনে এনে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।
পাকিস্তানে যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে দেশটাকে বারটা বাজিয়ে ছেড়েছে ঠিক একইভাবে এদেশকেও এরা চাচ্ছে উগ্রধর্মান্ধদের কেন্দ্রে পরিণত করতে। ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমনভাবে এরা বিরোধিতা করেছে ঠিক একই কায়দা এদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সময় মাঠে নামে। যেভাবে বছর দুয়েক আগে ভোলার ঘটনাটিও তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই হয়েছিল। কেননা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশের ওপরও তারা গুলি ছুড়ছে, পুলিশ মসজিদে আশ্রয় নিয়েও রক্ষা পায়নি। শান্তিপ্রিয় মুসলমান তো কখনও এ ধরনের কাজ করতে পারে না। ‘তৌহিদী জনতার’ কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করেছে তারা কতটুকু শান্তিপ্রিয়।
যারা ধর্মের নামে এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। এর পূর্বেও আমরা দেখেছি ধর্ম অবমাননার কথা বলে বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কখনও ইসলাম সমর্থন করে না। আজ যারা বিভিন্ন ধমীর্য় সংগঠনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পায়তারা করছে এবং বড় ধরনের নাশকতার চিন্তাভাবনা করছে তাদের বলতে চাই, আল্লাহর বাণীর মর্যাদা কি জ্বালাও পোড়াও করে অর্জিত হবে, নাকি আল্লাহর শিক্ষা ও মহানবীর (সা.) উত্তম আদর্শ স্থাপন করার মাধ্যমে অর্জিত হবে?
যেখানে পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তিনিই তার রসুলকে হেদায়াত ও সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন যেন তিনি সব ধর্মের ওপর একে বিজয়ী করে দেন, মুশরিকরা তা যতই অপছন্দ করুক’ (সুরা তাওবা: ৩২)। কে ইসলাম ধর্মকে পছন্দ করলো বা অপছন্দ করল তা দেখার জন্য কাউকে আল্লাহ মনোনিত করেননি। ইসলাম সত্য ধর্ম আর এই ধর্মকে সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করার ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহতায়ালারই।
এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম ধর্মের আদেশ এবং নীতির মাহত্ম বা পরমোৎকর্ষ ইতোমধ্যেই ক্রমশ স্বীকৃতি লাভ করে চলছে এবং সেদিন বেশি দূরে নয় যখন ইসলাম অন্যান্য সকল ধর্মবিশ্বাসের ওপর বিজয় লাভ করবে এবং সেইসব ধর্মের অনুসারীরা দলে দলে ইসলামের শান্তির ছায়াতলে সমবেত হবে। অবশ্যই সবাই এই শান্তির ধর্মে আশ্রয় নিবে তবে তা জঙ্গি কার্যক্রমের মাধ্যমে নয়, তা হবে কোরআনের উন্নত শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে এবং ঐশী একক নেতৃত্বের সুবাদে। ইসলাম পরিপূর্ণ একটি ধর্ম। এই ধর্মের কোন ক্ষতি করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়য়েছে ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম। আর আমি ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্মরূপে মনোনীত করলাম’ (সুরা মায়েদা: ৩)।
ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হলো, এটা প্রত্যেক মানুষকে ধমীর্য় স্বাধীনতা প্রদান করে। এই স্বাধীনতা কেবল ধর্ম-বিশ্বাস লালন-পালন করার স্বাধীনতা নয় বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জন করার স্বাধীনতাও এই ধর্মীয় স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তুমি বল, তোমার প্রতিপালক-প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য সমাগত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক’ (সুরা কাহাফ: ২৮ )। সত্য ও সুন্দর নিজ সত্তায় এত আকর্ষণীয় হয়ে থাকে যার কারণে মানুষ নিজে নিজেই এর দিকে আকৃষ্ট হয়।
বলপ্রয়োগ বা রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করে সত্যকে সত্য আর সুন্দরকে সুন্দর ঘোষণা করানো অজ্ঞতার পরিচায়ক। যেমন সূর্যোদয়ই সূর্যের অস্তিত্বের প্রমাণ। এই নিয়ে গায়ের জোর খাটানোর বা বিতণ্ডার অবকাশ নেই। সূর্যোদয় সত্ত্বেও কেউ যদি সূর্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাকে বোকা বলা যেতে পারে কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কিছুই নেই। ঠিক তেমনি কে আল্লাহকে মানলো বা মানলো না, কে ধর্ম করলো বা করলো না এটা নিয়ে এ জগতে বিচার বসানোর কোন শিক্ষা ইসলাম ধর্মে নেই। বরং এর বিচার পরকালে আল্লাহ নিজে করবেন বলে তার শেষ শরীয়ত গ্রন্থ আল কোরআনে বার বার জানিয়েছেন। এ স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে সমাজে আস্তিকও থাকবে, নাস্তিকও থাকবে। মুসলমানও থাকবে হিন্দুও থাকবে এবং অন্যান্য মতাবলম্বীরাও থাকবে। তাই বলে কোন ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার শিক্ষা কোন ধর্মই দেয় না। যার যার ধর্মকর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার শিক্ষাই প্রতিটি ধর্ম থেকেই পাওয়া যায়।
শেষে এটাই বলব সম্প্রীতির বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির কোন ঠাঁই নাই। ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য যারাই চেষ্টা করবে তাদের বিষয়ে সরকারকে যেমন আরো কঠোর হতে হবে তেমনি সমগ্র দেশবাসীকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা প্রতিহত করতে হবে।
এইচআর/জিকেএস