একটি বাড়ির আত্মকথা
একটি বাড়ি, একটি ইতিহাস; একটি স্বাধীন দেশের-স্বাধীন জাতির স্বপ্ন। আমরা সাধারণত বাড়ি বলতে ইট-কাঠ-বালু-পাথর কিংবা কাদা-মাটির নির্মিত কাঁচা ঘরকে বাড়ি বুঝি। আসলে কোনো কোনো বাড়ি হয়ে ওঠে তীর্থস্থানে; এর একটাই কারণ সেই বাড়ির বাসিন্দাদের কর্মময় জীবনের আলেখ্য উপামা থাকায়। আমাদেরও এমন একটি বাড়ি আছে, যা আজ তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। সেই বাড়িটি হলো বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকার ও মুক্তির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এক সময়ের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি; যার পরিবর্তিত বর্তমান ঠিকানা ১১ নং সড়কের ১০ নম্বর বাড়ি। কিন্তু আজও বাড়িটিকে মানুষ ৩২ নম্বর হিসেবে চেনে। কারণ শত-সহস্র ইতিহাস ও সংগ্রামের বাদ্য বেজেছে এই বাড়িতে। বাংলার দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সহায়ক চালিকাশক্তি ছিল তৎকালীন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের এই বড়িটি।
রাজনীতি একটি বহুমুখী শব্দ। ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িটি বহুমুখী শব্দটাকে একত্রিত করে অনন্য করে তুলেছিল, যা বাংলার মানুষের শুধু ভাবাবেগ-ভালোবাসা-অধিকার হিসেবে নয়, রীতিমতো তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছিল, যা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে দেশের আপামর জনগণ থেকে শুরু করে বিদেশি নাগরিকরাও। বাংলাদেশে কোনো বিদেশি এলে তার প্রথম স্বপ্ন থাকে অন্তত ৩২ নম্বরের স্মৃতিঘেরা এ বাড়িটি অবলোকনের।
১৯৬১ সালের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একমাত্র কারাগার ও রাজনৈতিক কাজে বাইরে যাওয়া ছাড়া এ বাড়িতেই কেটেছে জাতির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
বাংলাদেশ ও বাঙালির অধিকাংশ অর্জনের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আজও এ বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সগৌরব স্বমহিমায়। এই বাড়ি থেকে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি জান্তা সরকার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, মুক্তির সনদ ছেয়ট্টির ছয় দফা এ বাড়ি থেকে প্রণীত হয়। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়, যা পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত হয়। জান্তা সরকার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বৈঠকে যোগদানের প্রস্তাব দেয়; কিন্তু বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা তীক্ষè মেধার পরিচয় দিয়ে পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় কন্যা শেখ হাসিনাকে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জেলখানায় পাঠিয়ে প্যারোলে মুক্তি নিতে নিষেধ করেন। তখন বঙ্গবন্ধু বার্তা পেয়ে যান। এতে আওয়ামী লীগের নেতারা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা ও তার বড় কন্যা শেখ হাসিনার সাথে রাগারাগি করেন। তারা বঙ্গমাতাকে স্বামী হারানোর কথা ও কন্যাকে পিতা হারানোর কথা বলেন। তখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বলেন, তার সাথে আরও ৩৪ জন আছে। তাদের পরিবারও আছে; কতটা তীক্ষè মেধাবী আর মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায় তার এই গভীর উপলব্ধিতে। এজন্য তিনি প্যারোলো মুক্তি নিতে নিষেধ করেন। এরপর ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করলে ১৯৬৯ সালে জান্তা আইয়ুর সরকার বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করলে ২৩ ফেব্রæয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘‘বঙ্গবন্ধু’উপাধিতে ভূষিত করেন। এক কথায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির পেছনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বেঁকে বসার কারণে আন্দোলনের আগুনে ঘি ছড়িয়ে পড়ে। এটা এই ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে নির্দেশনা আসে।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনা ও নির্বাচনী কৌশল এই বাড়ি থেকে হয়। এরপর ১৯৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন, দলীয় নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ, দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা এই বাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধুর সাথে মতবিনিময় করেন। এ বাড়ি থেকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের রূপরেখা ঠিক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ৩২ নম্বর সড়কের এ বাড়ি থেকে ‘‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তাটি হলো- ‘THIS MAY BE MY LAST MESSAGE, FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FROM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED.” - Sheikh Mujibur Rahman (March 26, 1971).
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার মাধ্যমে দেশের আপামর জনগণ, ছাত্র-জনতা, পুলিশ সদস্য, ইপিআর ও বাঙালি সেনারা উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন-ভারত হয়ে স্বদেশে পর্দাপণ করে রাষ্ট্রনায়ক হয়েও এ বাড়িতে জীবন-যাপন শুরু করেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাড়িতে ফুল দিয়ে, ফেস্টুন ঝুলিয়ে কিংবা একনজর দেখে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের গতি সঞ্চার করত। কতটা আবেগ-ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকলে এমন করা যায় ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আর সেই বাড়িতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোরে ফজরের আজান শুরু হওয়া মাত্র জাতি এক কলঙ্ক লেপন করে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি পেতাত্মারা হত্যা করল সদ্য জন্ম নেওয়া উদীয়মান বাংলাদেশকে। খুনিরা বঙ্গবন্ধু কিংবা তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের হত্যা করেনি; হত্যা করেছে বাঙালি জাতিকে। খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একে একে
শেখ ফজিলাতুন নেছাসহ ১৬ জনকে হত্যা করে। তারা হলেন- বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, মেজ পুত্র শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র আপন ছোট ভাই শেখ আবু নাসের। এই মানুষগুলো হত্যা করে ৩২ নম্বরের বাড়িতে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতির বাড়িতে ঘাতকরা হত্যা করে ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার সন্তান বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, কিশোর আবদুল নঈম রিন্টু।
এছাড়া ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগনের বাড়িতে হামলা করে ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করে। তারা বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকেও হত্যা করে।
এবার ৩২ নম্বরের বাড়ি তৈরি ও জামি বরাদ্দের ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল কিছু আলোকপাত করা যায়। ১৯৫৭ সালের দিকে তৎকালীন সরকার ধানমন্ডি এলাকায় বাড়ি করার জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দিলে, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালে মন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করা নুরুল ইসলাম শেখ ফজিলাতুন নেছাকে গণপূর্ত বিভাগে একটি আবেদন করতে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম দেখলে সরকার বরাদ্দ দিতে কার্পণ্য করতে পারে; এসব ভেবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার নামে এক বিঘা জমি বরাদ্দের আবেদন করা হয়। যার বাজারমূল্য ছিল ছয় হাজার টাকা এবং জমি বরাদ্দ বাবদ প্রথমে এক হাজার টাকা জমা দিয়ে জমি বুঝে নিতে হবে। অনেক কষ্টে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা এক হাজার টাকা জোগাড় করে জমির মালিকানা পান। এরপর বঙ্গবন্ধু ১৯৬০ সালে কারগার থেকে মুক্তি পেলে একতলার তিনটি কক্ষ নির্মাণ করা হয়। এসময় নির্মাণ ব্যয় মেটাতে শেখ ফজিলাতুন নেছা নুরুল ইসলামের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নেন, যা পরবর্তীতে বঙ্গমাতা পরিশোধ করেন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। এরপর বাড়িটি দোতলা করতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার প্রায় ১০ বছর লেগেছিল। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি পঁচাত্তর-পরবর্তী মিলিটারি ডিকটেটর জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে কমপক্ষে ১০ বার ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটির সড়ক ও বাড়ি নম্বর পরিবর্তন করে। বর্তমানে বাড়িটির ঠিকানা ধানমন্ডির ১১ নম্বর সড়কে ১০ নম্বর বাড়ি হলেও পুরো জাতি ৩২ নম্বর নামে চেনে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বাড়ির মূল্য ছয় হাজার টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। সেই অজুহাতে ১৯৮১ সালে সুদসহ বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার টাকা। এরপর দেনার দায়ে বাড়িটি গোপনে নিলাম করতে একটি নামসর্বস্ব পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় উর্দি পরিহিত জেনারেল জিয়া। শেখ হাসিনা এ খবর পেয়ে নিলামে অংশ নিয়ে দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে বাড়িটি ক্রয় করেন। পিতা-মাতা হারিয়ে দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় ছেড়ে বাংলার দুঃখী মানুষের মনে হাসি ফোঁটাতে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফেরার পর সামরিক জান্তা জিয়া তাকে ৩২ নম্বর বাড়িতে ঢুকতে দেননি। এর চেয়ে কষ্টের কি আছে? নিজের বাপের বাড়ি এককথায় নিজের বাড়িতে ঢুকতে না পারার চেয়ে বেদনা পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে কিনা জাগ্রত বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলে পাওয়া যাবে। এরপর শেখ হাসিনা বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাসহ ১৫ আগস্ট শাহাদতবরণকারী সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করেন। এরপর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাড়ির মালিকানা ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টকে দিলে, ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িটিকে ‘‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। একটি বাড়ি, একটি জাতির স্বপ্ন-আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হতে পারে তা কালের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কের এ মহিমান্বিত বাড়িটি। যতকাল লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়ন থাকবে, ততদিন তুমি (৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি) থাকবে চির ভাস্বর।
লেখক
এম. এম. নাজমুল হাসান
সাবেক ছাত্রনেতা
জেএইচ/এমকেএইচ