গরম কড়াই, নাকি জ্বলন্ত চুলা?

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১১ আগস্ট ২০২১

একসময় আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম। নানা বিষয়ে তর্কবিতর্ক করতাম। এখন আর তেমন আড্ডা দেওয়া হয় না। ঢাকা শহরে চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া সবাই এখন জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সময় হয়ে ওঠে না। তাছাড়া গত দেড় বছর ধরে করোনার কারণে এক ধরনের অবরুদ্ধ জীবন চলছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়ার কথা একসময়ের আড্ডাবাজরাও ভাবতে পারেন না। অফিস যেতে হয়, তবে অফিস তো কাজের জায়গা, আড্ডার জায়গা নয়।

লিখতে বসে বিষয় নির্বাচন নিয়ে ভাবার সময় আমার হঠাৎ গত নির্বাচনের আগে আমাদের বন্ধুদের একটি আড্ডার কথা মনে হলো। নয়া পল্টনে এক বন্ধুর অফিসে সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছিল মুড়িচানাচুর পিঁয়াজমরিচ মাখা আর গরম চা সহযোগে। কথা সীমাবদ্ধ ছিল মূলত রাজনীতির মধ্যেই। কোনো বিষয়ে একমত হওয়া আমাদের ধাতে নেই। আমি একটা বললে আরেকজন পাল্টা আরেকটা বলেন। আবার তিনি যেটা বলেন আমি তার সঙ্গে এক মত না হয়ে ভিন্ন কথাই বলি । তবে আড্ডায় কোনো বিষয়ে একমত না হলেও যে তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় সেটা উপকারে লাগে, অন্তত আমার তো বটেই।

আওয়ামী লীগের চেয়ে উত্তম রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে না তুলে যারা পরিবর্তনের আওয়াজ তুলছেন তারা আমাদের গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলতে চাচ্ছেন না তো? আওয়ামী লীগকে শোধরানোর জন্য চাপ দেওয়া যেতে পারে এবং অবশ্যই এই চাপ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা সুবিবেচনাপ্রসূত কিনা, সবাইকে ভাবতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়

বিজ্ঞাপন

যাহোক, সেদিনের সে আড্ডায় আমি বঙ্গবন্ধুর সময়ে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন (আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি) এবং ন্যাপ-সিপিবি কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে 'সৎ ও যোগ্য' সরকার গঠনের দাবির প্রসঙ্গটি তোলায় কেউ কেউ বললেন, হ্যাঁ, তখন বঙ্গবন্ধু যদি তার 'ভাষায় চাটার দল'কে বাদ দিতেন তাহলে হয়তো ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা না-ও ঘটতে পারতো।

আরেক জন বললেন, এখনকার সংকটও তো তখনকার মতোই মনে হচ্ছে। রাজনীতিতে দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিদের দাপাদাপি মানুষ আর সহ্য করতে পারছে না। এখন কেউ সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠনের দাবি জানাচ্ছে না। তবে সচেতন সব মানুষের মধ্যেই একটি অস্বস্তি বিরাজ করছে। কেউ হয়তো প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করছেন না কিন্তু কিছু একটা পরিবর্তন আশা করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিত ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে ভালো ইমেজের নতুন মুখ মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করলে ভালো করতেন।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আরেকজনের মন্তব্য, তেমন কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। সবকিছু তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে। তিনি সাধারণত তার কোনো সহকর্মীকে বেকায়দায় ফেলেন না, বরং কেউ বেকায়দায় পড়লে তার পাশে দাঁড়ান। এটা তার এক বড় গুণ।

জবাবে আরেকজন বললেন, এই গুণ তাকে জনবিচ্ছিন্ন ও সমালোচিত করছে কি না সেটাও ভাবা দরকার। একজন সাংবাদিক বন্ধু বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে সম্ভবত এখন আর অন্য কারো মতামত তেমন বিবেচনায় নেন না । বিএনপির দাবি মতো সরকারকে বিদায় নিতে হবে না। তবে বিএনপি-জামায়াতের বাইরে, এমনকি আওয়ামী লীগের দলীয় বৃত্তের বাইরেও কিছু সৎ চিন্তার ভালো মানুষ আছেন, যারা শেখ হাসিনারও হয়তো হিতার্থী, তারা কি যেভাবে দেশ চলছে, তাতে খুশি? কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে পদে বহাল রেখে অনেক মানুষকে অখুশি করাটা মেনে নেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগকে তো একদিন নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। আবার ক্ষমতায় ফিরতে হলে মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ কিছু কাজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে করতেই হবে।

আড্ডায় একজন জানালেন, তার জানা মতে, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কেউ কেউ বহাল তবিয়তে আছে। তারা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে না। তিনি পরিচয় গোপন রাখতে চান বলে নামটি উল্লেখ করলাম না। সরকার নিজেই এভাবে বুঝে বা না বুঝে জামায়াত-শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আবার দেশবাসীকে জামায়াত-শিবিরের ভয় দেখালে কি তা কেউ ভালোভাবে নেয়? মানুষ চোখে দেখবে একটা আর কানে শুনবে আরেকটা- এটা তো মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বিভ্রান্ত মানুষ সরকারের জন্য ঝুঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আড্ডায় কারো কাছে তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু না শুনে আমার একটু ভয় বাড়লো। মনে হলো, না, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না। পরিবর্তন একটা দরকার। আলোচনাটা গত নির্বাচনের আগের। এই সময়কালে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ এসেছে। বিতর্কিতরা বাদ পড়েছেন। নতুনরা নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। তার নির্দেশ ছাড়া সব কেমন স্থবির। এটা কি ভালো লক্ষণ?

প্রসঙ্গত আরো কিছু বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনীতিতে যে স্থবিরতা চলছে তা কি স্বাভাবিক বলে মনে করা যায়? আমরা দেখেছি, বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের ডাক দিয়ে সাড়া দেয় না। মানুষ তাদের উপেক্ষা করছে। আবার ছাত্ররা একাধিকবার রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছে। প্রথমে কোটা সংস্কারের দাবিতে। পরে আবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে। ছাত্রদের নির্দোষ অরাজনৈতিক আন্দোলন বিএনপি-জামায়াত-বাম গণতান্ত্রিক জোট সবাই মিলে হাইজ্যাক করতে গিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুললেও সরকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতি এখন আর সেভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ধার ধারছে না।

অনেকের মনে প্রশ্ন, এরপর আবার কোন ইস্যুতে রাজপথ গরম হয়ে উঠবে? সরকারবিরোধীরা এক হওয়ার সুযোগ খুঁজছে। আওয়ামী লীগবিরোধী ডান-বামের অভূতপূর্ব ঐক্যের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের মিত্ররা অসন্তুষ্ট। অবশ্য বিএনপির মিত্ররাও সংহত নয়। তবে আগামী নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডান বাম মিলিত কোরাস গাইছে : আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা নাকি এখন দেশ বাঁচানোর একমাত্র উপায়।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ক্ষমতায় আসবে কে বা কারা? বিএনপির নেতৃত্বে পাঁচ মিশালী জোট? আওয়ামী লীগকে যত বার ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে ততবারই কি দেশ আরো পিছিয়ে যায়নি?পরিস্থিতি খারাপ হয়নি?

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল একদল করার অভিযোগে। তাঁকে হত্যার পরে কি গণতন্ত্র কায়েম হয়েছিল? ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ায় কি হয়েছিল দেশে? আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো বিকল্প কি বিএনপি-জামায়াত?বিদ্যুতের বদলে খাম্বা, সারের বদলে গুলি, জঙ্গিবাদের উত্থান – সেখানে কি ফিরে যেতে চাই? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য ধর্মবাদী শক্তির সঙ্গে আপোস করছে। কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা এখনও হয় না তা নয়। তবে জঙ্গি দমনে জিরো টলারেন্স নীতি থেকেও সরকার সরে আসছে না। বিএনপি ক্ষমতায় এলে জঙ্গি দমন করবে?

যারা ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য ব্যাকুল তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, পরিবর্তনের ফলে দেশ আরো ভালোর দিকে যাবে? দুর্নীতি হবে না? সুশাসন নিশ্চিত হবে? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন-পীড়নের শিকার হবে না?

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের চেয়ে উত্তম রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে না তুলে যারা পরিবর্তনের আওয়াজ তুলছেন তারা আমাদের গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলতে চাচ্ছেন না তো? আওয়ামী লীগকে শোধরানোর জন্য চাপ দেওয়া যেতে পারে এবং অবশ্যই এই চাপ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা সুবিবেচনাপ্রসূত কিনা, সবাইকে ভাবতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।