পরীমনি, হেলেনা, পিয়াসাদের অনাচারের সাজা দরকার

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:৩৮ এএম, ০৫ আগস্ট ২০২১

দেড়মাস আগে একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে সারাদেশে আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনিকে র‍্যাবের একটি দল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অভিযানের পর ৪ আগস্ট ২০২১ রাতে তার ঢাকার বাসা থেকে আটক করেছে। একই সঙ্গে পরীমনির ব্যক্তিগত গাড়িচালক ও বাসার একজন কর্মীকেও র‍্যাব তাদের হেফাজতে নিয়েছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত রাজ নামের একজন কথিত প্রযোজককেও রাতে আটক করেছে র‍্যাব। পরীর বাসায় অভিযানের সময় বিপুল পরিমাণ মদ ছাড়াও এলএসডি ও আইসের মতো মাদক উদ্ধারের তথ্য ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

কয়েকদিন ধরে কিছু আলোচিত গ্রেফতার অভিযান দিয়ে র‍্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ আলোড়ন তুলেছে। এর একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র আছে কিনা, এটি সরকারের বিশেষ অভিযানের অংশ কিনা আমি জানি না কিন্তু গ্রেফতারদের সামাজিক ইমেজ প্রায় একই রকম। এর আগে গত ৩০ জুলাই আওয়ামী লীগে পদ খোয়ানো ব্যবসায়ী নেতা হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় গভীর রাতে র‍্যাব অভিযান চালিয়ে তাকে আটকের পর গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। নানা অভিযোগে তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল এই নারীর। তবে শেষ পর্যন্ত বিতর্তিক হয়ে পড়েন আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামে নতুন সংগঠন খুলে। মিডিয়ায় খবর এসেছে, তার বাসায় মদ, হরিণের চামড়া, ক্যাসিনো বোর্ড, ওয়াকিটকিসহ বেশ কিছু অবৈধ সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।

হেলেনার পর অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে কথিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে। মাদক মামলায় তাদের তিন দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। এদের মিডিয়ার কেউ না চিনলেও রাতের আসরের সঙ্গী হিসেবে ওরা ঢাকার ধনিক সমাজের একটি শ্রেণির কাছে পরিচিত ছিল। পুলিশের ভাষ্য পিয়াসার অধীনে শতাধিক সুন্দরী তরুণী আছে। তাদের দিয়েই ধনীর দুলালদের নিজের ফাঁদে ফেলতেন পিয়াসা। বারিধারায় অভিজাত ফ্ল্যাটে বসবাস করেন, কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। অন্যদিকে মৌয়ের পরিচয় ‘লেডি মাফিয়া গ্যাং লিডার’ হিসেবে। ঢাকা শহরে নাকি একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে তার।

পুলিশ তাদের ‘রাতের রানী’ হিসেবেও পরিচয় করে দিয়েছে। অবশ্য সেটা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন সুশীল সমাজের কেউ কেউ। তাদের মডেল পরিচয় দেওয়া নিয়েতো রীতিমতো ক্ষিপ্ত মিডিয়া জগতের লোকেরা। কারণ এরা কী মডেলিং করেছে কেউ জানে না। অবশ্য পিয়াসা নামের নারীটি একটি বেসরকারি টিভিতে খুব স্বল্প সময়ের জন্য উপস্থাপনা করেছেন। ওই টিভির এমডির সঙ্গে পিয়াসার সখ্যতা ছিল। প্রতারণার দায়ে আগে থেকে সেই এমডি জেলে আছে।

হেলেনা, পিয়াসা, মৌর পরে বড় ধরনের খবর হয়ে আসেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। পরীমনি খবরের বোমা ফাটিয়েছিলেন গত মধ্য জুনে বোট ক্লাবে গিয়ে মাতলামি করা এবং ক্লাবের সদস্য ব্যবসায়ী নসির ইউ আহমদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে। তার কান্নার অভিনয় ক্ষণিকের জন্য সবাইকে ভুলিয়ে দিয়েছিল এবং তিনি সহানুভূতি অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ক্লাবের সিসি টিভির ফুটেজ তার ইমেজকে ফুটো করে দিতে সময় নেয়নি। তার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন আকাশ-পাতাল ব্যবধানের জীবনযাপন আর বোট ক্লাব ‘নাটকের’ পর্দা উঠে যাওয়ায় পরীমনি কেন গ্রেফতার হচ্ছেন না- এতোদিন সেটাই ছিল সবার বিস্ময়ের বিষয়।

হেলেনা, পরীমনি, পিয়াসা, মৌর গ্রেফতাদের কারণ ঠিক এক রকম না হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ব্যাক্তি চরিত্র একইরকমভাবে চিত্রিত করা আছে। গ্রেফতাদের আগে থেকেই তাদেরকে নিয়ে এভাবে কথা হতো এবং হচ্ছে। তবে একটি মিল সবার ক্ষেত্রে পুলিশই দিয়েছে। তাদের সবার বাসায় মদ পাওয়া গিয়েছে।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ পাওয়ার ঘটনায় অবশ্য তার মেয়ে মিডিয়ায় উল্লেখ করেছেন যে হেলেনার ছেলের লাইসেন্স আছে মদ খাওয়ার। লাইসেন্স থাকা না থাকা পরের বিষয়। মদ রাখার জন্য কাউকে গ্রেফতার করা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে। আলোচিত হওয়ার আরেকটা কারণ এসব গ্রেফতারের সংবাদে মদকে প্রাধান্য দেওয়া। যাদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে এরচেয়ে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও তাদের বাসায় মদ পাওয়াকে সামনে নিয়ে আসায় আসল অভিযোগ তলিয়ে যাচ্ছে। তবে ইয়াবা, আইস বা এলএসডির মতো মাদকের বিষয়টা আলাদা। ড্রাগ বহনকারীদের কঠোর সাজার দরকার আছে।

মদ নিয়ে বাংলাদেশের আইন বিতর্কিত এবং বিপরীতধর্মী। কেউ মদ রাখলে গ্রেফতার হচ্ছে অথচ সে ব্যক্তি ক্লাবে বা বারে গিয়ে মদ খেতে পারছে। টাকা হলেই সব সম্ভব। ডাক্তারদের কাছ থেকে ভূয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অবৈধভাবে লাইসেন্স নিচ্ছে মদ খাওয়ার। অভিজাত ক্লাবগুলোতে মদ খাওয়া ছাড়া কোন্ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়! ক্লাবে রিক্রিয়েশন মানেই মদের আড্ডা। যারা সেখানে যায়, মেম্বার হয় তারা অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে হয় না। এসব ওপেন সিক্রেট হওয়ার পরেও যখন কারো বাসায় আধা বোতল মদ পাওয়া গেলেও মামলা দেওয়া হয়- সেটা হাস্যকর।

১/১১ কালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদসহ অনেককে এমন হাস্যকর মামলা দেওয়া হয়েছিল। এসব মামলার পরিণতি আগে থেকেই জানা যায়। তাছাড়া একটি উঠতি ধনী রাষ্ট্রে মদকে এতো নেতিবাচক হিসেবে উত্থাপনের কোনো কারণ দেখি না। মদ খাওয়া আর ক্যাসিনোতে যাওয়ার জন্য কি তাহলে ওই ধনীরা বিদেশে যাবে! মদ জুয়া খারাপ তারা না জেনেই ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর- আমেরিকায় টাকা উড়িয়ে আসে! সময়ের সঙ্গে এসবও আমাদের ভাবা উচিত। কোন সরকার প্রধান কতো বড় ধার্মিক- এটা প্রমাণের চেষ্টা আমাদের শাসকদের মাঝে আগে থেকে লক্ষণীয় এবং প্রতিপক্ষকে ধর্ম-কর্মহীন প্রমাণেরও  আপ্রাণ চেষ্টা আছে তাদের। এটা পরিহার করা উচিত।

আলোচিত তিন গ্রেফতারে হেলেনার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হওয়া উচিত টাকার বিনিময়ে নেতা বানানো এবং তথাকথিত একটি আইপি টিভি দিয়ে সাংবাদিক নিয়োগ। এর মাধ্যমে তিনি রাজনীতি এবং সাংবাদিকতা পেশাকে নষ্ট করছেন। তার বাসায় কিছু বিদেশি মুদ্রা পাওয়া, হরিণের চামড়া পাওয়া, মদ উদ্ধার বর্তমানকালে খুবই নগন্য বিষয়। হেলেনা আরও কিছু অনৈতিক কাজে লিপ্ত আছেন বলে অভিযোগ, যেটা তথ্য প্রমাণের অভাব আছে বলে আমি উল্লেখ করতে চাই না। পুলিশেরই খুঁজে বের করা উচিত। নাকের ডগায় হেলেনা, পিয়াসা, পরীরা যেসব কাজ করছেন- পুলিশ তাদের দেখেও না দেখার ভাব করে ছিলেন এতোদিন।

পিয়াসা, পরী, মৌদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন জীবনযাপন নতুন কিছু নয়। হঠাৎ করে পুলিশের- র‍্যাবের বোধোদয় হয়েছে বলে তাকে আমি নেতিবাচক দৃষ্টিতেও দেখতে চাই না। কিন্তু এসব অভিযান যেন বৃথা না যায় এবং সমাজের এই জাতীয় অনাচার যেন কঠিন হাতে দমন করা হয়। শুধু এদেরকে গ্রেফতার এবং সাজা নয়, তারা যাদের সেল্টারে আছে বা ছিল তাদের মুখোশও উন্মোচিত করে সাজার ব্যবস্থ্যা করা হোক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। [email protected]

আরএইচ/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।